Ticker

6/recent/ticker-posts

গল্প : মাননীয় : আবদুর রাকিব

গল্প : মাননীয়

-- আবদুর রাকিব

দরখাস্তের তলায় নাম সই করে , প্রয়ােজনীয় কাগজ পত্র আলপিনে গাঁথতে গাঁথতে আলি আসগর বললেন , ‘ ব্যস , আর রইল বাকী দুই ।'


নিপুন কারীগরের মত সাবুইঘাসের ঝাড়ু , বানাচ্ছিলেন আমিনা। তাঁর কথা বুঝতে না পেরে ভুরু কুঁচকে বললেন , ‘ কি বাকী রইল ?'


‘ আমার চাকরীর এক্সটেনস্যান ।  আর দুটো এক্সটেনস্যান পাব । আজ স্কুলে এই কাগজপত্র জমা দেব । আর দুবার দরখাস্ত দিলে খেল খতম । তখন আমি হব সময়ের রাজা । আর তুমি হবে রাণী ।'


আমিনা তাঁর ঠোঁট দুখানির ওপর সামান্য শক্তি প্রয়ােগ করলেন । অনেকগুলি এলােমেলাে রেখায় তাঁর প্রশান্ত মুখখানি বিকৃত হল । তিনি কোন কথা বললেন না । আলি আসগর ও-মুখের প্রতিটি রেখার বক্তব্য বােঝেন । ওখানে কখন আসে সকালের আলাে , কখন পড়ে দুপুরের রােদ , কখন নামে গােধুলির ছায়া , সব তিনি জানেন । তিনি তাই হাসলেন । সময়ের রাজা হওয়ার পর , তাঁর রাজ্যপাটের হালটা কি রকম দাঁড়াবে , তাও তিনি অনুমান করতে পারেন । বড় রাজপুত্র বি.এ. পাশ করে বেকার । ছােটটি সুখী রাজপুত্রের মত নিজের যা কিছু সম্পদ বিদ্যা , বুদ্ধি , প্রেম , ভালােবাসা— পরের তরে বিলিয়ে দেয় , আর ঘরের খায় । দুই রাজকন্যার বিয়ে হয়েছে । তৃতীয়া পড়ছে স্কুলে । চাকরীর খেলা শেষ করে তিনি যখন সময়ের সিংহাসনে সমারুঢ় হবেন , তখন তাঁর রাজ্যের সীমানা কতদূর বিস্তৃত হবে , আমিনার সঙ্গে সে নিয়ে অনেকবার তিনি আলােচনা করেছেন । 


তবুও সারা মুখে হাসি ছড়িয়ে অনাগত দিনের একটি জানালা খুলে আমিনাকে তিনি টেনে আনতে চাইলেন । আমিনা এলেন না । একখানি ঝাড়ু তার কাছে আপাতত খুব জরুরী । তিনি এখন নিপুণ কারিগর । আমিনার মুখের রােদ থেকে চোখ সরিয়ে এনে তাঁর নিজের সইটার ওপর বসিয়ে দিলেন আলি আসগর । আগাগােড়া তিনি তাঁর নামের রূপ , রূপশ্রী আর বর্ণমালা দেখতে লাগলেন । দেখতে দেখতে এক অহেতুক মুগ্ধতায় আবিষ্ট হলেন। ডুবে গেলেন। মজে গেলেন। তাঁর মনে হল, এ শুধু তাঁর নামের স্বাক্ষর নয়, অনেক বিশ্বাসের এক মহতী নির্মান, আর বিরাট প্রতিশ্রুতির প্রতিবর্ণীকরণ।


নিজের ওপর তাঁর এটা শ্রদ্ধা না ভালােবাসা, না প্রচ্ছন্ন অহঙ্কার, কিছুই ঠিক করতে পারলেন না আলি আসগর। তবে আজ অনেকখানি স্নিগ্ধ সরস আর বায়বীয় হয়ে তিনি তাঁর স্কুলের পথে পা বাড়ালেন। কিছু, দূরে এসে, তিনি সদর রাস্তা ধরে যাবেন, নাকি রাস্তাটা টপকে ঐ পাড়ার গলিপথে ঢুকবেন, না আলের পথে মাঠ ভেঙে স্কুলে যাবেন, ঠিক করার জন্য দাঁড়িয়ে গেলেন। আজকাল প্রায়ই তাকে পথ নির্বাচনের সমস্যা পড়তে হয়।


গলিপথে পথ ছোট হয়। কিন্ত যে সময়ে তিনি। স্কুলে যান আর বাড়ি ফেরেন, সে সময়ে ও-পাড়ার মেয়েরা গলিপথ আগলে থাকে। কেননা ভােরে উঠে ও-পাড়ার পুরুষেরা—তরুণ এবং কিশােরেরা গােপালপুরে পাহাড়ে যায় পাথর ভাঙতে, আর ফিরে আসে রাতের আঁধারে। পুরো একটা দিন হাতে পেয়ে মেয়েরা তার বার আনা খরচ করে গলির ভেতর। খেলে আড্ডা দেয়, আর ঝগড়া করে। তখন শরীর নিয়ে তারা সজাগ নয়, চুলােচুলির সময় কাঁর আঁচল কোথায় যায়, কেউ জানেনা, কার জিভে কোন্ কথার জন্ম আর মত্যু হয়, কেউ খেয়াল রাখেনা। কিন্তু, আলি আসগর অন্ধ অথবা বধির নন। তার চোখ তার কান, তার অনুভতি তাঁকে বড় পীড়া দেয়। তাঁকে দেখামাত্র তারা অবশ্যি জিভের ওপর দাঁত বসায়, পিঠ ঘুরিয়ে দাঁড়ায়। এবং তাড়াহুড়াে করে শরীর সামলাতে গিয়ে যে অঙ্গ ঢাকাবার, তাই উদাম রাখে। তাদের চেয়ে তিনিই বেশী অপ্রস্তুত হন।


আর সদর রাস্তার মােড়ে বেশ কয়েকখানি মনােরঞ্জনী কাপড় চোপড়, চা, তেলেভাজা, পান বিড়ি সিগারেটের দোকান। একটা বাজার বাজার ভাব। পাড়া গাঁয়ে এরকম একটা ছােটখাট বাজার থাকা দরকার বলে আলি আসগর মনে করেন। কিন্তু সম্প্রতি তিনি লক্ষ্য করেছেন, বেচাকেনার বদলে দোকানওলি ঘিরে একটা গা-ঢালা আরামের আসর চলছে অবিরাম। হাত-পা ছড়িয়ে গল্প করছে কেউ, কেউ অশ্লীল ভাষায় গালাগালি দিচ্ছে। তর্ক করছে অনর্গল। মারামারি করছে যখন তখন, পান বিড়ি সিগারেটের দোকানে অল্পবয়সীদের ভিড়। টেপ আর ট্রানজিসটর। একটার পর একটা বিড়ি সিগারেট ফুঁকে,গানের সঙ্গে গলা মিলিয়ে, ঢলাঢলি করে তাজা তাজা ছেলেরা দিনরাত ফুরিয়ে যাচ্ছে। পাড়া গাঁয়ের বিশুদ্ধ বাতাসে শুরু হয়েছে শহরের দূষন। এই সরল তরল, শিথিল দিন-যাপন কি সময়ের থাবা থেকে, শহরের ব্যাধি থেকে ঐ সবুজ প্রাণগুলিকে রক্ষা করতে পারবে?


তিনি যখন এই মোড় পার হন, তখন গলিপথের মেয়েদের মত আড্ডাধারীরাও ঈষৎ চঞ্চল হয়। অনেকে বিড়ি সিগারেট লুকায়। হাতের হাওয়ায় ধোঁয়া তাড়ায়, তাস-খেলুড়েদের কেউ কেউ পাখির মত মুখ গুঁজে তাঁর উপস্থিতির দমকা ঝড় এড়িয়ে যায়। তিনি মাননীয় বলে তাঁকেও সঙ্কুচিত হতে হয়।


দুটি পথই তাঁর অস্বস্তির কারণ।


তৃতীয় পথটি তিনি নিজেই খুঁজে নিয়েছেন। ছােট এক ডোবার ধার ঘেঁষে, গাছগাছালির তলা দিয়ে খানিকটা মাথা নুইয়ে বেরিয়ে গেলেই তিনি একটা আল পথ পান, অপেক্ষাকৃত নির্জন আর নিরাপদ পথ। মাঝে শুধু সুধীন ফুলমালীর কুঁড়েঘরের এক চিলতে উঠোন। ঘরের দিকে তাকালে দেওয়ালে টাঙানো গঙ্গাবতরনের ছবিটা চোখে পড়ে। উঠোনের পাশ দিয়ে যেতে যেতে মাত্র একদিনই তিনি ছবিখানা দেখেছিলেন। দ্বিতীয়বার সে ভুল আর করেননি। সুধীন বাড়ি থাকলে, কপালে হাত ঠেকিয়ে মুখে বলে 'আদাব।' আদাবের আদব-কায়দাটা এ অঞ্চলে এখনও এরকম। তাঁর ইচ্ছে হয়, তিনি সুধীনকে বলবেন, কপালে হাত দেবার দরকার নেই সুধীন। আর, আদাব না বলে 'সালাম' জানাও। সালাম মানে শান্তি। শান্তি কামনার চেয়ে সুন্দরতর আর কিছু হতে পারে না। কিন্তু পরক্ষণে মনে হয়, না থাক। শ্রদ্ধা জ্ঞাপণের জন্য ভাষাটা কোন ব্যাপার নয়। সসম্ভ্রম অভিব্যক্তিই সবচেয়ে সুন্দর ভাষা। তিনি যদি দেখতে জানেন, তাহলে মানুষের একজোড়া চোখ দেখেই তার হৃদয়ের ভাষা তিনি পড়ে নিতে পারবেন।


সুধীনের মায়ের সঙ্গে দেখা হলে আলি আসগর রসিকতা করেন, 'কি করছ গাে কালাে বৌ ? তােমার সতীন ডেকেছে।'



বুড়ি যখন বােঝে এটা আলি মাস্টারের গলা, তখন ঝাপসা চোখ দুটি পিট পিট করে বলে, 'চোখে দেখিতে পাইনি গ’ আলি মিঞা। সতীনকে পাঠিন দিও। শাশুড়ির কথা শুনে সুধীনের বউ ঘােমটার ভেতরে হাসে। আলি আসগরও হাসিতে আক্রান্ত হয়ে উঠোন পেরিয়ে চলে যান।


একটু থেমে আজ তিনি আলপথটাই ধরলেন। কোমরের পেছনে একখানি হাতের ভেতর আরেকখানি হাত রেখে তিনি আরামে হেঁটে চললেন। কয়েকখণ্ড ছোট বড় জমির বুনুনি ভেদ করে এ পথ তাঁকে পৌছে দেবে স্কুলের পেছনে আম গাছের তলায়। একটি ছোট দরজা দিয়ে তিনি স্কুলে ঢুকবেন। সুধীনের উঠোন ফাঁকা। ঘরের দাওয়ায় শুয়ে আছে কালাে বৌ। একবার তাকে ডাক দেবেন মনে করলেন। কিন্ত কি ভেবে আর ডাকলেন না।


এখন মাঠ জুড়ে সরষের হলুদ ফুল। অল্প কিছু গমের খেত, গম চাষে লাভ নেই বলে চাষীরা এখন সরষে বুনছেন। একটা সুবাস ছড়িয়ে আছে মাঠময়, বর্ষায় পানি-কাদায় একটু অসুবিধা হয় এ রাস্তায়। পা পিছলে আলী আসগর পড়েও গিয়েছিলেন একদিন। কিন্তু তাও তাঁর ভাল লেগেছিল। আসলে বৃষ্টি কিংবা বর্ষা না হলে মাঠ মাটিকে ঠিক বোঝা যায় না। তার গন্ধ, তার মেজাজ ধরা পড়ে না। বৃষ্টি নামলে মাটির ভেতর আত্মদানের মত একটা আনন্দ আর আকুলতা আসে। রসানুভূতির আবেগ মাটি কেউ শিথিল করে। মাঠের চাষীও সঞ্জীবিত হয় বর্ষায়। তারও গা থেকে একটা গন্ধ বেরোয়। আলি আসগর এ গন্ধটুকু ধরে রাখেন বুকের তলায়। অনেক পোকা-মাকড়ও এই সময়ে তিনি চিনে রাখেন। নানা জাতের কীট পতঙ্গেরা কি করে বাঁচে আর ডাকে, তা নিয়ে তিনি ভাবতে ভালোবাসেন।


আর শরতের সবুজ ধানচারা সব আবিলতা শুষে নিয়ে তাঁকে প্রাণের রঙ চেনায়। শীতের সবজী আনে প্রচুর্যের আভাস। আর ফিকে হয়ে ফুরিয়ে যাওয়ার আগে বসন্তও এক উদাসী স্মৃতির আর আসন্ন প্রত্যাশার দুয়ার খুলে দেয়।


মাঠের এই পথটুকু তাঁকে জীবন দেয়। জীবনী শক্তিও।


এক সময় অলের ওপর দাঁড়ালেন। কাল বিকেলে বাড়ি ফেরার সময় এই জায়গায় তিনি দেখেছিলেন চার-পাঁচটি ছেলে আলের ওপর বসে গাঁজার কলকেয় টান দিচ্ছে। সরষে ফুলের সুগন্ধ ছাপিয়ে একটা উৎকট ঝাঁজ তার নাকে এসেছিল। ছেলে গুলিকে তাঁর পরিচিত মনে হয়নি। হতে পারে তারা ভিডিও দেখতে এসেছিল নিবারণবাবুর বাড়িতে। অথবা বরযাত্রী হয়ে এসেছিল দীন মহম্মদের মেয়ের বিয়েতে। অথবা। অন্য উদ্দেশ্যে তারা এসেছিল যা তাঁর জানার কথা নয়।


মাথা নীচু করে তিনি দিব্যি চলে যেতে পারতেন। কিন্তু কি যে হল তার হঠাৎ দাঁড়িয়ে গম্ভীর গলায় বললেন, 'এই যে। বাড়ি কোথায় তােমাদের? রাস্তায় বসে গাঁজা টানছ?'


সবচেয়ে সুন্দর যে ছেলেটি, সে বললে, 'রাস্তা কোথায়, এটাত মাঠের আল।'


একজন বললে, 'একটান দেবেন নাকি দাদু?'


রাগে কাঁপতে কাঁপতে আলি আসগর গর্জন করে উঠলেন, 'আস্পর্ধা ত কম নয়। ওঠো, ওঠো এখান থেকে।'


‘যান-যান।' তাচ্ছিল্য করে একজন বললে। 'নিজের বাপের পয়সায় খাচ্ছি। আমরা আপনার জামাই নয় যে আপনার পণের টাকায় গাঁজা টানছি।'


বন্ধুর কথার সূত্র ধরে একজন বললে, 'আমাদের শ্বশুর হওয়ার ইচ্ছে হয়েছে দাদর। তাই আমাদের চরিত্রি সংশােধন করছেন।'


সমবেত হাসির দমকে মাঠখানি কেঁপে উঠল। আর বয়স আর বিচক্ষণতা ভুলে গিয়ে আলি আসগর একগুঁয়ে শিশুর মত রুখে দাঁড়ালেন। দু-একবার তাকালেন বড় রাস্তা, বাগান আর স্কুলের দিকে। বাগানে কিছু ছেলে খেলা করছিল। তিনি চিৎকার করে তাদের ডাকলেন। তখন গঞ্জীকাসেবীদের মনে হল, দাদু হয়ত স্কুলের এক জন শিক্ষক হবেন। আর তা যদি হয়, তাহলে তাঁর হকুমে স্কুলের ছাত্রেরা শিকারী কুকুরের মত তাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বে। তাদের মধ্যে কেউ কেউ উঠে দাঁড়াল। এবং যখন দেখল, বাগানের দিক থেকে একদল ছেলে ছুটে আসছে, তখন তারাও দুড়দাড় করে দৌড়ে পালাল, আলি আসগর এমন উত্তেজিত হয়েছিলেন যে তিনি তাঁর ছেলেদের সব কথা গুছিয়ে বলতে পারলেন না।


এখন তাঁর মনে হচ্ছে, একদিক দিয়ে সেটা ভালই হয়েছিল। না হলে খুব বাড়াবাড়ি হয়ে যেত, এবং তিনি তার নায়ক বলে চিহ্নিত হতেন। এখনও তিনি ভাবছেন; কাল তিনি জয়ী হয়ে ছিলেন, কিন্ত খুশী হতে পারেন নি। তাঁর যে সম্মান মুখ থুবড়ে পড়েছিল মাটিতে, বাগানের ছেলেদের সাহায্যে তিনি তাকে তুলে আনতে পারেন নি, কারুর সাহায্য না নিয়ে তিনি যদি বখাটে ছেলেগুলির সুন্দর সুন্দর হাত থেকে গাঁজার কলকেটা নামিয়ে দিতে পারতেন, তা হলে তিনি খুশি হতে পারতেন। আজ তার এ-ও মনে হচ্ছে, এই আলকে তিনি রাস্তা বলে ভুল করেছিলেন। এর ওপর দিয়ে। তিনি হেঁটে যাবেন বলেই সেটা পথ হয়ে যায় না। তার চোখের আড়ালে, নির্জনে অনেককিছু আপত্তিকর কাজ হয়। হয়ে আসছে চিরকাল, হবেও। তাঁর অত খবরদাবির কাজ কি। চারপাশের জীবন চলেছে। আপন খেয়ালে। আপন নিয়মে। তিনি কি তাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন? ইচ্ছেমত ঘােরাতে পারবেন তাঁর চেনা পৃথিবীতে? তাঁর ডাকে যারা ছুটে এসেছিল, তিনি কি তাদের তাঁর পথে পরিচালিত করতে পারবেন?


একটা যন্ত্রণার অনুভূতি নিয়ে তিনি বুঝতে পারলেন, অনেক দিন থেকে ক্রমশ তিনি হেরে আসছেন। এতদিন টের পাননি। কাল বিকেলে জয়ী হওয়ার জন্য তিনি যেভাবে মরিয়া হয়ে উঠেছিলেন, তাতেই সেটা স্পষ্ট হয়ে গেল। তিনি দ্রুত জায়গাটা পার হয়ে গেলেন।


স্কুলে এসে হাজিরা খাতায় সই করে আলি আসগর হেডমাস্টার মশায়ের টেবিলে তাঁর এক্সটেনস্যানের কাগজ পত্র জমা দিলেন, হেমেন মিত্র কি একটা লিখছিলেন। বললেন, ‘বসুন কথা আছে।'


ঘণ্টা পড়তে এখনও দেরী আছে। সহকর্মীরা এক দুই করে এসে জুটছেন। এই সময় আলি আসগর তাঁদের সঙ্গে একটু গল্প গুজব করেন নব বিবাহিত অনিমেষ আর নবোঢ়া মিনতি এখন তাঁর লক্ষ্য। অযাচিত উপদেশ দিয়ে তিনি অনিমেষকে বলেন, 'বিরহী বলে একটা বাজার আছে নদীয়ায়। তুমি সেখানে গিয়ে কিছুদিন কাটিয়ে এস। তাহলে বিরহ ব্যথাটা আর বুঝতে পারবে না। মিনতিকে বলেন, আধুনিকা হবার প্রথম পাঠ হল, তােমাদের শয়নকক্ষটিকে দ্বি-শয্যাবিশিষ্ট করে তোলা। সাবধান একই শয্যায় শায়িত হবে না। বলে হা হা হাসিতে ঘরখানিকে তিনি উদ্দাম করে তোলেন। পরে গম্ভীর মুখে তিনি বলেন, 'অশোকের এ অনুশাসনগুলিকে হৃদয়পটে খােদাই করে রেখো ভাই, পরে কাজে লাগবে।'


এই রকম নানা সরস মন্তব্যে তিনি মুখর হন। আজ তাঁর মন ভাল ছিল না। কিন্ত তাঁর বিশ্বাস ছিল, তাঁর নির্দিষ্ট চেয়ারখানিতে গিয়ে বসলে, রাজা বিক্রমাদিত্যের মত তিনি মেজাজ ফিরে পাবেন। শুকনো পাতা ঝরিয়ে দিয়ে অচিরেই তিনি কিশলয় হয়ে দুলে উঠবেন। কিন্ত হেমেন মিত্র তাঁকে বসতে বলেছেন। অনিচ্ছাসত্বেও তিনি একটুখানি চেয়ায় টেনে বসলেন।


একটু গম্ভীর দেখাচ্ছে হেমেন মিত্রকে। মুখের ওপর থমকে আছে একটা হালকা ছায়া, জোলাে হওয়া বইছে চোখের পাতা কাঁপিয়ে। সব মিলিয়ে অস্বাভাবিকতা লক্ষ্য করলেন আলি আসগর।


হাতের কাজ শেষ করে হেমেন মিত্র আলি আসগরের আবেদন পত্রের ওপর চোখ রাখলেন। আলি আসগর অস্বস্তি বােধ করলেন। এখানে এভাবে বসে থাকতে তাঁর একদম ভালাে লাগছেনা। যেন কেউ কেউ তাঁকে বন্দী করেছে। আর তিনি মুক্তির জন্য ছটপট করছেন। হেমেন মিত্র কাগজপত্র একপাশে সরিয়ে রেখে কিছুক্ষণ পরে বললেন, শুনছি, স্কুলে একটা ডেপুটেশন আসবে।


ডেপুটেশন কিসের? কার কাছে শুনলে? আলি আসগর হেমেন মিত্রকে হেমেন বলেই ডাকেন। সরাসরি ছাত্র তিনি নন। তবে ছাত্রতুল্য। বয়সে তরুণ হেমেন হাসলেন। বিপন্ন হাসি নয়। একটা কৌতুকের ঝিলিক আছে এ হাসিতে। বললেন, 'শুনেছি, অভিভাবক সমিতির সদস্যরা আসছেন। আপনি কিন্ত চলে যাবেন না যেন। আপনাকে তাদের মোকাবেলা করতে হবে।'


স্কুলে আবার অভিভাবক সমিতি কবে হল? একটু অবাক হলেন আলি আসগর।


কিন্ত ডেপুটেশনের দল দেখে তিনি আরও অবাক হলেন। কারা এরা? কয়েকজন তরণ। একজনকেও অভিভাবক বলে তাঁর মনে হল না। ভোরের কুয়াশা সরে গিয়ে সব কিছু যেমন স্পষ্ট হয়, তেমনি ছেলে গুলিকেও ক্রমশ তিনি চিনে ফেললেন। অনেকেই স্কুলের প্রাক্তন ছাত্র। যারা ছিল রােগ, পাঁশুটে, প্রাণহীন, তারা আজ সবল, সুখী আর উজ্জ্বল। শৈলাবাসের স্যানাটোরিয়াম থেকে আয়ু আর স্বাস্থ্য নিয়ে ক্ষয় রোগীরা যেন ফিরে এসেছে আজ। কোথায় ছিল এরা এতদিন? কোথায় ঘুমিয়ে ছিল এতগুলি যৌবন? শরীরে না মনে? অধ্যয়নে? অধ্যবসায়ে? জীবিকায়? জীবনে? নাকি আলস্যে, অসাফল্যে, হতাশায় অথবা ক্লান্তিতে?


সদর রাস্তার দোকানে বহুদিন বহভাবে তিনি তাঁদের দেখেছেন। কিন্তু কারুর কোন খোঁজ নেওয়া হয়নি। আজ প্রায় প্রত্যেকেরই তিনি খোঁজ নিলেন। একজন রেলের বুকিং ক্লার্ক। একজন প্রাইমারী স্কুলের শিক্ষক। একজন কোঅপারেটিভ ব্যাঙ্কের কর্মচারী। বাকিরা বেকার। কেউ গ্রাম পঞ্চায়েতের সদস্য। কেউ প্রধান। কেউ পার্টির নেতা। কেউ কলেজের ছাত্র। সবাই মিলে একটা স্কুলের অসুখ নির্ণয় ও নিরাময়ের জন্য ওরা আজ এগিয়ে আসেছে!


তাদের লিখিত অভিযােগ মন দিয়ে দিয়ে পড়লেন আলি আসগর। তাদের দাবীগুলিও তিনি জেনে নিলেন। তার ঠোঁট দু'খানির ওপর একটা অপষ্ট হাসি লেপ্টে রইল সারাক্ষণ। পড়া শেষ করে, চশমা খুলে তিনি তরুণদের দিকে তাকালেন। তাঁর চাউনি তির্যক ছিল না। অতলস্পর্শী না। তবে তাঁর চোখ দেখে মনে হল, ও দুটি বুঝি ছাঁকনির কাজ করছে। তিনি একবার হেমেন মিত্রকেও মনােযােগ দিয়ে দেখলেন। তারপর বললেন, 'তােমরা অভিভাবক সমিতির লােক বলে উল্লেখ করেছ। তোমরা কে কার অভিভাবক, একটু পরিচয় দেবে?'


তরুণেরা মুখ চাওয়া-চাওয়ি করল কিছুক্ষণ। পরে শ্যামল বললে, ‘ আমি তনু সাহার দাদা।'


‘ তােমাদের বাবা বেচে আছেন। তুমি অভিভাবক হও কি করে?'


শ্যামল একটু থতমত খেল। তারপর বললে, ‘আমি তাঁর প্রতিনিধি হয়ে এসেছি।' 'ঠিক আছে। তনুর অঙ্ক আর ইতিহাস বই নেই। আমি ইতিহাসখানা যােগাড় করে দিয়েছি। কিন্ত অঙ্ক? তুমি জান তার বই নেই?'


‘ না।'


জানা উচিৎ ছিল তােমার। বলে চশমাটা আবার চোখে বসালেন আলি আসগর। তারপর, অভিযােগ পত্রের ওপর দৃষ্টি ফেলে বললেন, যাকগে, তােমরা বলেছ, মাস্টার মশায়রা মাধ্যমিক পরীক্ষার সেন্টারে গিয়ে ছাত্র-ছাত্রীদের তদারকি করেন না। ফলে পরীক্ষার ফল খারাপ হচ্ছে। তার মানে, তােমরা চাও, ওঁরা পরীক্ষার হলে গিয়ে ছাত্র-ছাত্রীদের বলে দিন, তাই না?'


একজন বললে, 'হ্যা।'


আলি আসগরের ঠোঁটের হাসি আরও স্পষ্ট আর রঙিন দেখাল। বললেন ‘ মুখে যা খুশি বলা যায়।  কিন্তু যখন কিছু লিখে জানাবে, তখন একটু সতর্ক হওয়া দরকার। তোমরা যদি অভিযোগ করতে যে, মাস্টার মশায়রা ভাল করে করে ক্লাস করেন না, কোর্স শেষ করতে পারেন না। তাহলে আমরা অবশ্যই আত্মসমীক্ষা করতাম। কিন্তু পরীক্ষার হলে ফিয়ে তাঁরা বলে দেবেন, টোকাটুকিতে সাহায্য করবেন,  এটা কি কোন কথা হল? না, এসব কথা অভিযােগপত্রে লেখা যায়? এ যুক্তি কে দেয়েছে তােমাদের?'


তপন বিজলী রেখার মত উঠে দাঁড়ায়। বলে, ‘ আপনি কি মনে করেন, অন্যের যুক্তিতে আমরা ডেপুটেশনে এসেছি? ওসব ভাল ভাল কথা বাদ দিন। সবাই যা করছে। আপনাদেরও তাই করতে হবে।'


‘ অর্থাৎ দুনীতি করতে হবে? ’


সরাসরি ‘হ্যাঁ’ না বলে সামাদ বললে, ‘ ঠিক তা নয়। তবে ছেলেমেয়েদের মুখ চেয়ে আপনাদের একটু সাহায্য করতে হবে। বুঝতেই পারছেন, কোথাও নীতি, আদর্শ মেনে কাজ হয় না। ’


আলি আসগর এ কথার উত্তর না দিয়ে বললেন, ‘ তােমাদের আরেকটি অভিযােগ, মাস্টারমশায়রা ট্যুইশানি করেন না। ’


সঙ্গে সঙ্গে জাফর বলে, ‘ হ্যাঁ, এটা খুবই দুঃখের কথা। শহরে প্রতিটি ছেলেমেয়ের প্রাইভেট টিউটর অাছে। আর আমাদের ছেলেমেয়ের একটুও কোচিং পায় না। ’ ‘হু’ বলে মিটিমিটি হাসতে হাসতে আলি আসগর সহকর্মীদের বলেন, ‘ গুরতর অভিযােগ। তােমরা স্কুলে পড়াও আর না পড়াও, বাড়ি গিয়ে ট্যুইশানি কর। তােমাদের দুটো পয়সা হবে, ছেলেমেয়েদেরও উপকার হবে। বুঝলে? ’


বরুণ হঠাৎ তেতে উঠল। ‘ আপনি কি পরিহাস করছেন? আমরা কি পরিহাসের পাত্র? ’ ‘ না, বরুন, না, তোমরা আমার ছাত্র। তবে তোমার মনে আছে বােধ হয়, তুমি আমাকে বলেছিলে সুধীরবাব, তাঁর প্রাইভেট ছাত্রদের কাছে প্রশ্ন ফাঁস করে প্রচুর নবর পাইয়ে দেন। বলনি? ’


‘ আমার অত মনে নেই। ’


‘ আমার আছে। মাষ্টার মশাররা ট্যুইশানি না করলে অভিযোগ করবে, করলে অপবাদ দেবে। অাসলে তােমরা কি চাও, তােমরা জান না। অথবা যা চাও তা বলছ না। ’


বরুণ বললে, ‘ আমরা চাই, আপনি চুপ করুন। আমরা আপনার কথা শুনতে আসিনি। আমরা হেডমাস্টারের কাছে এসেছি। তিনি কি বলেন, আমরা তাই শুনতে চাই। ’


বরুণের কথায় তার বন্ধুরা বল পেল। এতক্ষণ একটা বাধ-বাধ ভাব ছিল। তাদের মনে হচ্ছিল তারা হেরে যাচ্ছে। তাদের কথা তেমন জোর দিয়ে বলতে পারছে না। মনে হচ্ছিল, অভিযােগ পত্রের মুসাবিদা তেমন সুবিধের হয়নি? স্ববিরােধিতা আর যুক্তিহীনতার জালে তারা জড়িয়ে পড়ছে। কিন্তু এবার, অভিযােগের অক্ষর মালা থেকে তারা বেরিয়ে এল অবরােধ মুক্ত , উত্তাল জলস্রোতের মত । একজন বললে , ‘ স্কুলটাকে আপনারা আপনাদের পৈতৃক সম্পত্তি মনে করেন । স্কুলে এসে গুলতানি কারেন । ’ অন্যজন বললে , ‘ আপনারা দেরী করে স্কুলে যান , আর বেরিয়ে আসেন ঘণ্টা পড়ার আগে । রুটিন অনুযায়ী ক্লাশ হয় না আপনাদের । ’ তৃতীয়জন বললে , ‘ আপনারা যখন খুশী স্কুলে আসেন, যেদিন খুশী ছটি দেন । একটা কুকুর মরলেও , আপনারা শােকসভা করে তার আত্মার সদগতি কামনা করেন । তারপর হাসতে হাসতে বাড়ি যান । অথচ , পার্টি ডাকে সাড়া দিয়ে একদিনও বনধ পালন করেন না । সরকার অাপনাদের মাইনে দেয় । সরকার চাইবে , বনধ আপনারা পলিন করবেন । ’ চতুর্থজন বললে , ‘ আপনারা দুর্নীতি করেন না ? আপনাদের ছেলে-মেয়েরা ক্লাসে কেন ফার্স্ট , সেকেণ্ড , থার্ড হয় ? পরীক্ষার আগে আপনাদের প্রশ্ন কেন আউট হয় ? ’


তাঁর মেয়ে ক্লাসের ফার্স্ট গার্ল বলেই বােধ হয় আলি আসগর চুপ করে বসে থাকতে পারলেন না , ‘ তুমি প্রমাণ দিতে পার ? ’


এক সঙ্গে গর্জে উঠল তরুনের দল । ‘ আপনি চুপ করন । যত নষ্টের মূল আপনিই । আপনিই শিক্ষকদের একই সমিতির সদস্য হতে বাধা দেন । স্কুলে ছাত্রদের ইউনিয়ন করতে দিচ্ছেন না আপনিই । শিক্ষকদের প্রাইভেট ট্যুইশানি আপনিই বন্ধ করছেন । আপনিই তাঁদের সেন্টারে যেতে নিষেধ করেছেন । ম্যানেজং কমিটির ইলেকশনে আপনি আড়ালে বসে কলকাঠি নাড়েন । অ্যাপয়মেন্টের ব্যপারেও আপনি নাক গলান । শিক্ষকদের ওপর প্রভাব বিস্তার করে আপনি হেডমাস্টারের নানা কাজে বাধার সৃষ্টি করেন । অতই যদি আপনি আদর্শবাদী , তাহলে আর এক্সটেনস্যান নিচ্ছেন কেন ? চাকরীটা ছেড়ে দিন, আপনার জায়গায় একটা বেকার ছেলে কাজ পাবে । ’


আলি আসগর বােবা হয়ে গেলেন । কিন্তু মুখ খুললেন হেমেন মিত্র । বললেন , ‘ না , না তোমরা ওভাবে কথা বলছ কেন ? উনি...’ ‘ না কোন কথা নয় । উনি এখানে উপস্থিত থাকলে আমরা ওয়াক আউট করব । ’ ‘ হ্যাঁ , হ্যাঁ , চল '— বলে পার্টির যুব নেতা উঠে দাঁড়াল । 


‘ না , তােমরা না । আমিই চলে যাচ্ছি । হেমেন না বললে , আমি অবশ্য তোমাদের ডেপুটেশনের সম্মুখীন হতাম না । কিন্তু হেমেন — আচ্ছা যাক,’ বলে ধীর পায়ে টেবিলের ওপর থেকে এক্সটেনস্যানের কাগজ-পত্র তুলে নিয়ে আলি আসগর ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন । দুঃখী , ব্যথিতের মত নীরবে , নতমুখে। তাঁর সহকর্মীরাও তাঁকে অনুসরণ করলেন । বরুণ সবাইকে শুনিয়ে তাঁর বন্ধুদের বললে, ‘ কারা কারা চলে যাচ্ছে , নােট করে রাখ , পরে ব্যবস্থা নেব । বাস্তুঘুঘুদের আখড়াটা ভাঙতেই হবে । ’


সেই আলপথ ধরেই আলি আসগর বাড়ি ফিরলেন । পেছন ফিরে একবার দেখলেন , জামগাছের তলায় দাঁড়িয়ে তাঁর স্নেহের সহকর্মী বন্ধুরা তাঁর যাওয়া দেখছে । দেখতে দেখতে তাঁদের শরীরগুলি অচমকা ছায়া হয়ে হয়ে গেল । তিনি চোখ ফিরিয়ে নিলেন । শীতের বিদায় আসন্ন । কিন্তু এখনও একটা ঠাণ্ডা হাওয়ায় গায়ে কাঁটা দেয় । আমের পাতা ফুঁড়ে উঁকি দিচ্ছে অজস্র মকুল । রঙের আয়োজন শুরু হয়েছে শিমূল পলাশে । আলি আসগরের মনে হল । তার ছেলেবেলায় এই সময় তিনি দু'একটা কোকিলের ডাক শুনতে পেতেন । যেন বসন্তের আগমণী সুর । দূর বসন্তের দেশ থেকে কোকিলদের যাত্রা শুরু হয় নি ? 


তাঁকে দেখে মাঠের চাষী বেলাল বিনীত হাসি ছড়াল । সুধীন কপালে হাত ঠেকিয়ে বললে , ‘আদাব ।’ সুধীরের বউ ঘোমটা টেনে দূরে গিয়ে দাঁড়াল । আলি আসগর উঠান পেরিয়ে দাওয়ার নীচে তাঁর শয়িতা কালো বৌ-এর খবর নিলেন । কঁকিয়ে উঠল বুড়ি । তার কালচে নীরক্ত ঠোঁটের কাঁপুনি দেখে তিনি বুঝলেন তার সতীনের আগমনের আগেই হয়ত সুধীনের মায়ের চোখের পাতাগুলি চিরদিনের মত বন্ধ হয়ে যাবে । তিনি ধীর পায়ে বেরিয়ে এলেন । 


বড় রাস্তার মােড়ে পেড ট্রাম প্রতিযোগিতার বিবরণ । ঘােষণা করা হচ্ছে মাইকে । আলি আসগর শুনতে পেলেন । পেড ট্রাম প্রতিযােগিতা কি , তিনি জানেন না । তবে অনুমান করলেন , ওটা এখন দারুন জমে উঠেছে । 


অন্যমনস্ক ছিলেন বলেই বোধ হয় পায়ে পায়ে তিনি গলি - পথে এসে ঢুকলেন । তাঁকে দেখামাত্র গলির প্রতিবেশীনীরা দ্রুত চলে গেল আব্রুর আড়ালে । আলি আসগর সচেতন ভাবে পা চালিয়েই পথটা পার হয়ে হয়ে এলেন । তাঁর মনে হল , এই মুহুর্তে এখনও তিনি মাননীয় । সব পথ সমান ভাবে তাঁকে সম্মান দেয় । পথ নির্বাচনের কোন প্রয়ােজন নেই তাঁর । আজ প্রয়ােজন শুধু মত পরিবর্তনের ।



বাড়ি ফিরে এক্সটেনস্যানের কাগজপত্র দেখিয়ে আলি আসগর আমিনাকে বললেন, ‘ বুঝলে গ’ রাজা হবার লােভে , আর তােমাকে রাণী করার লালসায় দু’বছরও আমি সবুর করতে পারলাম না । আগামী পয়লা এপ্রিলেই তােমার আর আমার অভিষেক । ’


হেঁয়ালীটা বুঝতে কিছু দেরী হল আমিনার । যখন বুঝলেন , তখন সজল মেঘের ছায়ায় তাঁর মুখখানি ঢেকে গেল । এবং একবার দু’চোখে জ্বলে উঠল বিদ্যুতের আগুন । বললেন , ‘ এমনি করে তুমি হটে আসবে ? হেরে যাবে ? ’ আলি আসগর বললেন , ‘ হ্যাঁ । হেরে যেতে আমাকে হবেই । চাকরী ছেড়ে না দিলেও হবে । হেমেন চায় , শিক্ষকেরা রাজনীতি করুন , আমি চাই শিক্ষকতা করুন । হেমেন চায় , ছাত্রেরা ইউনিয়ন করুক , আমি চাই ওরা পড়াশুনা করুক । স্কুল কমিটিতে পার্টির লোক আসুক । আমি চাই , শিক্ষানুরাগীরা আসন । মোটা টাকা নিয়েও শিক্ষক নিয়ােগ করতে চায় , আমি চাই শুধু সুযােগ্য শিক্ষক । ও চায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে রাজনীতির প্রভুত্ব আর প্রতিষ্ঠা । আমি চাই শিক্ষানীতির সর্বৈব বিকাশ । কত অমিল আমাদের । হেমেন এ কালের হেড মাষ্টার । সক্রিয় পার্টি করে। তার হাতে অঢেল শক্তি আর যুক্তি । আমি তাঁকে পেরে উঠব কেন ? ’ আমিনা বললেন , ‘ কিন্তু হেমেন ত তােমাকে শ্রদ্ধা করে । ’


‘ না , গাে , না । ওটা শ্রদ্ধা নয় , ভয় । আমার বিশ্বাস আর আদর্শকে ভয় । তবে অদ্ভুত সৌজন্য হেমেনের । সরাসরি ঘা না দিয়ে , কৌশলে ডেপুটেশনের অনুষ্ঠান করে সে আমাকে বুঝিয়ে দিলে যে আমি এখন অনায়াসে অপমানিত হতে পারি । কিন্তু হেমেন জানেনা যে , আমার ফুরিয়ে যাওয়া চলেনা । তাঁর প্রভুত্ব যখন নির্বিঘ্ন হবে , তখন হট্টগােলের ভিড়ে সে সত্যিকারের একজন কাজের লােক খুঁজবে । তখন আমার কথা তার মনে পড়বে । ওটাই ত আমার সম্মান , কি বল ? ’


কিন্তু কিছু বলার জোর পেলেন না আমিনা ।


__________________________

• (সৌজন্যে: ‘কাফেলা’ পত্রিকার মে-জুন ১৯৮৬ সংখ্যা। সম্পাদক: আব্দুল আজীজ আল-আমান)


• আবদুর রাকিব: আবদুর রাকিবের জন্ম ১৯৩৯ খ্রীষ্টাব্দের ১৬ই মার্চ। মুরারই রেল স্টেশন থেকে সাড়ে সাত কিলোমিটার দূরের এক প্রাচীন জনপদ-- এদরাকপুর গ্রামে তাঁর জন্ম। বাবা আখতার হোসেন ও মা মরিয়ম নেসা। বাবা পেশায় প্রাথমিক স্কুলশিক্ষক। চার ভাই ও এক বোনের মধ্যে সর্বকনিষ্ঠ আবদুর রাকিব।


ছেলেবেলা থেকেই বইপত্র পড়তে ভালোবাসতেন রাকিব। বাবার সামান্য মাইনের কারণে সংসারে ছিল অস্বচ্ছলতা। তাই রাকিব বইপত্রের মধ্যেই ডুবে থেকে মনের শান্তি খুঁজে নিতেন। আর বাস্তবের জীবনকে নানান দিক দিয়ে ভেঙে ভেঙে কলমের আঁচড়ে তুলে ধরতেন কলেজের পত্রিকায়। রাকিবের গল্পের চরিত্ররা মূলত গ্রামসমাজের হতদরিদ্র মেহনতি মানুষ, যাদের বিত্তবৈভব কৌলিন্য কিছুই নেই। যাঁদের শিক্ষা নেই, আভিজাত্য নেই। দারিদ্রের সঙ্গে প্রতিদিন লড়াই করেও যাঁদের মধ্যে আছে একটা নৈতিকতা, মূল্যবোধ। তিনি তাঁদের কথাই লিখতেন। ২৯ বছর বয়সে মুর্শিদাবাদের জিনদিঘির কবিয়াল গুমানী দেওয়ানকে নিয়ে লিখে ফেলেন ‘চারণ কবি গুমানী দেওয়ান’ নামের একটি জীবন আলেখ্য। এই গ্রন্থে এক দিকে গুমানী দেওয়ানের জীবন বৃত্তান্ত নিপুণভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন, সেই সঙ্গে তুলে ধরেছেন হাস্যরসে সিক্ত কবিগানের বিষয়বস্তুকে। ২০০১ সালে পশ্চিমবঙ্গ তথ্য সংস্কৃতি দফতর বইটি দ্বিতীয়বার প্রকাশ করে। 


অসংখ্য তাঁর সাহিত্য কৃতি। তার মধ্যে ‘আব্দুর রাকিবের নির্বাচিত গল্প’, ‘বেড়ে ওঠার দিনগুলি’, ‘পথ পসারির পত্রোত্তর’ প্রভৃতি গ্রন্থ বিশেষ উল্লেখের দাবি রাখে।


আবদুর রাকিব পেশায় মুর্শিদাবাদের বোখারা হাজি যুবেদ আলী বিদ্যাপীঠের বাংলাভাষা ও সাহিত্যের শিক্ষক ছিলেন। নেশা ছিল নীরবে নিভৃতে লেখালিখি। তাকে বীরভূম জেলার ‘সাহিত্য অভিভাবক’ বলা হয়। ২০১৮-র ২১শে নভেম্বর আবদুর রাকিবের অকস্মাৎ প্রয়াণ বাংলা সাহিত্যের ক্ষেত্রে এক গভীর শূন্যতার সৃষ্টি করেছে।