Ticker

6/recent/ticker-posts

কপোতাক্ষ নদ -- মাইকেল মধুসূদন দত্ত -- ব্যাখ্যা -- প্রশ্ন উত্তর -- Haldibari 24 Ghonta

কপোতাক্ষ নদ
-- মাইকেল মধুসূদন দত্ত

সতত, হে নদ, তুমি পড় মোর মনে। 
সতত তোমার কথা ভাবি এ বিরলে; 
সতত (যেমতি লোক নিশার স্বপনে 
শোনে মায়া-মন্ত্রধ্বনি) তব কলকলে- 
জুড়াই এ কান আমি ভ্রান্তির ছলনে- 
বহু দেশে দেখিয়াছি বহু নদ-দলে, 
কিন্তু এ স্নেহের তৃয়া মিটে কার জলে? 
দুগ্ধ-স্রোতোরূপী তুমি জন্ম-ভূমি-স্তনে! 
আর কি হে হবে দেখা?- যতদিন যাবে, 
প্রজারূপে রাজরূপ সাগরেরে দিতে 
বারি-রূপ কর তুমি; এ মিনতি, গাবে 
বঙ্গজ-জনের কানে, সখে, সখা-রীতে 
নাম তার, এ প্রবাসে মজি' প্রেমভাবে 
লইছে যে তব নাম বঙ্গের সংগীতে!


→ শব্দার্থ: [ Word meaning ] 

কপোত = পায়রা, Pigeon.
অক্ষি = চোখ।
কপোতাক্ষ নদ = এর উৎপত্তি যশোর জেলার চৌগাছা উপজেলায় ভৈরব নদী থেকে এবং এটি পরে খুলনা জেলার কয়রায় খোলপটুয়া নদীতে গিয়ে পতিত হয়েছে।
সতত = সর্বদা, Always.
বিরল = নির্জন যায়গা, Solitary. 
বিরলে = নির্জন যায়গায়।
যেমতি = যেমন করে (কাব্যে)।
নিশার = রাত্রির, রজনীর।
মায়া = বিভ্রম, Illusion.
মন্ত্র = পবিত্র উচ্চারণ (ধর্মীয়), Hymn.
ধ্বনি = রব, স্বর, Voice.
জুড়ান = তৃপ্ত করা, তৃপ্ত হওয়া, have a sense of relief, refreshed, satisfied. 
ভ্রান্তি = ভুল। 
ভ্রান্তির ছলনে = ভুলের ছলনায়।
ছলনা = প্রতারণা, কপটতা, ধোঁকা, প্রবঞ্চনা, falsehood. 
স্নেহের = ভালোবাসার।
স্নেহ = মমতা, অনুরাগ, affection.
দুগ্ধ = দুধ, স্তন্য।
স্রোত = জলপ্রবাহ, stream.
স্তন = পয়োধর, মাই, woman's breast. 
দুগ্ধ-স্রোতোরূপী = দুগ্ধের স্রোত, তার মতো।
বারি = জল, water.
রূপ = মত, in form of.
প্রজারূপে = কপোতাক্ষ নদকে এখানে প্রজারূপে কল্পনা করা হয়েছে। 
রাজরূপ = রাজার সঙ্গে সাগরকে তুলনা করা হয়েছে। 
কর = খাজনা, রাজস্ব, Tax. 
বঙ্গজ = বঙ্গে যে জন্মেছে। 
মিনতি = প্রার্থনা, prayer. 
সখা-রীতে = বন্ধুত্ব রীতিতে। 
প্রবাসে = বিদেশে। 
মজি', মজিয়া = মুগ্ধ হওয়া (impress), আসক্ত হওয়া ( lose oneself ).
বঙ্গের সংগীতে = বাংলা ভাষায় রচিত গানে।


>>

মূল কবিতা:
"সতত, হে নদ তুমি পড় মোর মনে
সতত তোমার কথা ভাবি এ বিরলে;"

ব্যাখ্যা (explanation): 
ফ্রান্সের ভার্সেই শহরে থাকাকালীন কবি এই কবিতাটি রচনা করেন। বিদেশে থাকাকালীন সর্বদা শৈশবের গ্রামের কপোতাক্ষ নদের কথা কবির মনে পড়ে। একান্ত নিরিবিলিতে সবসময় কপোতাক্ষ নদের কথা তিনি ভাবেন।


মূল কবিতা:
"সতত (যেমতি’ লোক নিশার স্বপনে
শোনে মায়া যন্ত্র ধ্বনি) তব কল-কলে---
জুড়াই এ কান আমি ভ্রান্তি’র ছলনে---"

ব্যাখ্যা (explanation): 
রাতে মানুষ ঘুমের মাঝে স্বপ্ন দেখে। মায়া মন্ত্র ধ্বনিতে আচ্ছন্ন হয়। স্বপ্নের মধ্যে যা দেখতে পায় সবই তো ভ্রান্ত। তন্দ্রা থেকে জেগে মানুষ উপলব্দি করে এটা স্বপ্ন ছিল এবং মিথ্যা। কবিও যেন তেমনই কপােতাক্ষকে নিয়ে স্বপ্নে বিভাের হন। বিদেশে জলের কলকল ধ্বনিকে  কপোতাক্ষ নদীর কলধ্বনি মনে করেন। তিনি নদের কলকল শব্দে বয়ে চলা যেন তার গ্রাম থেকে বহু দূরে থেকেও অনুভব করেন। সত্যি না হলেও সেই কলকলে তাঁর মন তৃপ্ত হয়। 


মূল কবিতা: 
"বহু দেশে দেখিয়াছি বহু নদ-দলে,
কিন্তু এ স্নেহের তৃষ্ণা মিটে কার জলে?
দুগ্ধ-স্রোতোরূপী তুমি জন্ম-ভূমি-স্তনে!" 

ব্যাখ্যা (explanation): 
কবি প্রবাসে থাকাকালীন বহু দেশে বহু নদ-নদী দেখেছেন। অজস্র নদীর জলে নিজের তৃষ্ণা মেটাতে চেয়েছিলেন। কিন্তু, সেই নদী তাঁর তৃষ্ণা মেটাতে পারেনি। তিনি শৈশবে তাঁর প্রিয় কপোতাক্ষ নদের জল পান করেছেন; তাই অন্যান্য নদীর জলে তাঁর তৃষ্ণা মেটে না। জন্মভূমি আর তার মাঝে বয়ে চলা নদীর প্রতি কবির ভালোবাসা প্রকাশ পায় এই কবিতায়। কবির ভাষায় তার জন্মভূমি যেন মায়ের স্তন। এবং কপোতাক্ষ নদের জলপ্রবাহ যেন মায়ের বুকের দুধ। এই নদীর প্রবাহ যেন মায়ের বুকের দুধের মত তাঁর তৃষ্ণা মেটায়। 
            


মূল কবিতা: 
"আর কি হে হবে দেখা? ---যতদিন যাবে,
প্রজারূপে রাজরূপ সাগরেরে দিতে 
বারি-রূপ কর তুমি; এ মিনতি, গাবে 
বঙ্গজ-জনের কানে, সখে, সখা-রীতে 
নাম তার, এ প্রবাসে মজি' প্রেমভাবে 
লইছে যে নাম তব বঙ্গের সংগীতে!" 

ব্যাখ্যা (explanation): 
বহুদিন হল কবি প্রবাসে। তিনি ভাবছেন তাঁর শৈশবের সেই নদের সাথে আর কি দেখা হবে! আর সকল নদীর মত কপোতাক্ষ নদও কলকল স্রোত নিয়ে সাগরে গিয়ে মেশে। প্রজা যেমন রাজাকে কর দেয়, কপোতাক্ষ নদও যেন প্রজারূপে তার জলধারা কর হিসেবে সাগরকে প্রদান করে। প্রবাসে আটকে পড়া কবি আকূল চিত্তে বাংলার কপোতাক্ষ নদের নামে কবিতা লিখছেন গান গাইছেন। কবি প্রার্থনা করেছেন যে বন্ধু কপোতাক্ষ নদ যেন বন্ধুত্বের খাতিরে তার বয়ে চলা জলরাশির কলকল রবে সেই কাব্য-গান বাঙ্গলার মানুষের কাছে আজীবন গেয়ে শোনায়। কবির ইচ্ছে কপোতাক্ষ নদ যেন তার জলরাশির কলকল রবে তাঁকে চিরদিন ধরে রাখে। যদি কোনােদিন তিনি তার প্রিয় নদী কপােতাক্ষের তীরে আর ফিরে যেতে নাও পারেন তবু যেন কপােতাক্ষ নদ কবিকে মনে রাখে, বাংলার মানুষের কাছে তার এই ভালোবাসার কথা পৌছে দেয়; তাকে যেন সস্নেহে স্মরণ করে। প্রবাসে থাকা কবি তাঁর দেশপ্রেমকে এই কবিতায় যথার্থরূপে ফুটিয়ে তুলেছেন।



==> প্রশ্ন উত্তর <==

Q: "কপোতাক্ষ নদ" কবিতা অবলম্বনে কবির বঙ্গপ্রীতির পরিচয় দাও। 
or,
কপোতাক্ষ নদ কবিতায় কবির স্বদেশ প্রেমের পরিচয় দাও। 


Ans: বাংলা ভাষায় প্রথম চতুর্দশপদী কবিতা বা সনেট লেখার কৃতিত্ব মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের। সনেটের বাংলা নাম চতুর্দশপদী তিনিই দিয়েছেন। "কপোতাক্ষ নদ" কবিতাটি তাঁর লেখা একটি চতুর্দশপদী কবিতা বা সনেট। এই কবিতার মধ্যে দিয়ে কবির স্বদেশ-- সুজলা সুফলা বাংলার প্রতি তাঁর গভীর ভালোবাসার পরিচয় পাওয়া যায়। 

বিশ্বের প্রায় সকল সভ্যতা গড়ে উঠেছে বিভিন্ন নদ-নদীর দুই পাড়ের সবুজ ভূমিতে। দেশ ও মাটির প্রতি আমাদের প্রেমের উৎসস্থল যেন এই নদীগুলির সজল স্রোতধারা। কবির স্বদেশের প্রতি প্রেমের উৎসও যেন তাঁর সাগরদাঁড়ি গ্রামের ওপর দিয়ে প্রবাহিত হওয়া কপোতাক্ষ নদ। 

ইউরোপীয় সাহিত্যে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার ইচ্ছা নিয়ে তিনি দেশান্তরে পাড়ি দিলেও– স্বদেশ বঙ্গভূমির আকাশ-বাতাস-মাঠ-নদীর জন্য তাঁর হৃদয় সর্বদা ব্যাকুল হয়ে ওঠে। জননী বঙ্গভূমি পরম মাতৃস্নেহে যেন সর্বদা কবিকে স্বদেশে ফেরার আহ্বান করে। তাই তিনি বারবার ফিরে যেতে চেয়েছেন তার প্রিয় বাংলাদেশে। 

কপোতাক্ষ নদকে ঘিরে কবির শৈশবের নানা ঘটনা ও  স্মৃতি তাঁর স্মরণে ও চেতনায় সদাজাগ্রত। কবির গ্রাম, শৈশবের দিন আর কপোতাক্ষ নদের স্মৃতি– সকল যেন সর্বদা তাঁকে আহ্বান করে স্বদেশে। শয়নে স্বপ্নে কবি যেন মায়া মন্ত্রধ্বনীর মত অনুভব করেন কপোতাক্ষ নদের কলকল বয়ে যাওয়া। পাশ্চাত্য (western) দেশে কবি বহু নদনদী প্রত্যক্ষ করেছেন। প্রতিটি নদনদী আপন সৌন্দর্যে অপরূপ কিন্তু শৈশবের স্মৃতিবিজড়িত কপোতাক্ষ নদের দর্শন বিনা কবির তৃষ্ণা মেটে না। কপোতাক্ষ নদের জল যেন মায়ের বুকের দুগ্ধধারা। 

দেশান্তরে গিয়ে কবির মনে পড়ে দেশের কথা, গ্রামের কপোতাক্ষ নদের কথা। আর সেই স্মৃতি তাকে যন্ত্রণা দেয়। কবির মনে সংশয় হয় আর কখনো কপোতাক্ষ নদের দর্শন তিনি পাবেন কি না! তাই তিনি কপোতাক্ষ নদের কাছে প্রার্থনা করেছেন-- বঙ্গের প্রতি তাঁর গভীর ভালোবাসার এই কাব্য-গীতকে কপোতাক্ষ নদ যেন স্রোতের কলরোলে বঙ্গবাসীকে আজীবন শুনিয়ে যাবে।

চতুর্দশপদী এই কবিতা মহাকবি মাইকেলের স্বদেশপ্রেমের এক উৎকৃষ্ট নিদর্শন।