“
'বিজলী টকিজ' নামে হলদিবাড়িতে প্রথম সিনেমা চালু হয় ১৯৪৬-এর জুন বা জুলাইয়ে, পি ভি এন এন হল ভাড়া নিয়ে, মাসখানেকের জন্য। এর আগে পর্যন্ত হলদিবাড়ির মানুষদের সিনেমার স্বাদ পেতে হলে যেতে হত জলপাইগুড়ি...
”
ডেস্ক:
হলদিবাড়ি ২৪ ঘন্টা

“কোচবিহার দর্পণ”-এর ১৭ নভেম্বর, ১৯৩৮ সংখ্যায় হলদিবাড়ি মেলা প্রসঙ্গে পাই-- “বিখ্যাস সার্কাস, বায়োস্কোপ, টকি প্রভৃতি আসিয়া মেলাটিকে পূর্ণাঙ্গ করিয়া তোলে,” – কিন্তু প্রকৃতপক্ষে ১৯৪০ থেকে যাঁরা মেলার প্রত্যক্ষদর্শী তাঁরা মেলার অবলুপ্তি পর্যন্ত কোন ও টকি বা বায়োস্কোপ দেখেছেন বলে মনে করতে পারেন না। ১৯৪০-এর আগেও কখনও দেখা গেছে বলে শোনা যায় নি।
'বিজলী টকিজ' নামে হলদিবাড়িতে প্রথম সিনেমা চালু হয় ১৯৪৬-এর জুন বা জুলাইয়ে, পি ভি এন এন হল ভাড়া নিয়ে, মাসখানেকের জন্য। এর আগে পর্যন্ত হলদিবাড়ির মানুষদের সিনেমার স্বাদ পেতে হলে যেতে হত জলপাইগুড়ি, সুতরাং সিনেমা দেখাটা ছিল সাধারণ মানুষদের কাছে বিরল ঘটনা, দু'একজন উৎসাহীর কথা বাদ দিলে। 'বিজলী টকিজ' হলদিবাড়ির কিছু মানুষের অভ্যাসে বদল আনলেন। মালিক ছিলেন সৈয়দপুর কিংবা নিলফামারির বাসিন্দা। দু'টি শো হত - ৩টে থেকে ৬টা, ৬টা থেকে ৯টা। সে সময়ের টিনের হলঘরে যে স্টেজ ছিল (বর্তমানে রবীন্দ্রভবনের যে দিকে স্টেজ সে দিকেই) তার পেছনে গ্রীণরুমে প্রোজেক্টর বসানো হয়। সিঙ্গল মেশিন ব্যবহার করা হোত, ফলে রোল বদলানোর জন্য কিছু সময়ের জন্য শো বিরতি দেওয়া হত। তিন-চারদিন অন্তর বই বদলানো হত। 'ঠিকাদার', 'জিপসি মেয়ে', 'সার্কাস সুন্দরী'-এসব ছবি দেখানো হয়েছিল। 'আলিবাবা' তখনকার জনপ্রিয় ছবি। ড্রাম বাজিয়ে, বালির কাগজে ছাপা হ্যান্ডবিল বিলি করে চলতি বা আসন্ন ছবির প্রচার চলত। 'শেষ উত্তর', 'ডাক্তার' বিজলীতে দেখানো হয়েছিল। লীলা চিটনিস, রমলা, পঙ্কজ মল্লিক, কানন বালার সঙ্গে হলদিবাড়ির দর্শকের পরিচয় হোল । তিনটি অস্থায়ী রেষ্টোরান্ট বসেছিল লাইব্রেরী চতুরে, তারমধ্যে একটি কিশোর লাইব্রেরীর পরিচালনায়, লাইব্রেরীর উন্নতিকল্পে। বর্ষার দিনে দর্শক হোত কম, ফলে রেষ্টোরান্ট ব্যবসাতে ক্ষতিই হয়েছিল।
এরপর স্থায়ীভাবে সিনেমা দেখানোর উদ্যোগ নিলেন ধীরেন্দ্রনাথ কুন্ডু, মণি কুন্ডু নামেই যিনি বেশি পরিচিত ছিলেন। এই মানুষটি নানা ধরনের ব্যবসায়িক উদ্যোগ নিয়েছিলেন নানা সময়, আর্থিক লাভের চেয়েও নূতন কিছু করার ঝোঁকটাই ছিল বেশি। তিনিও পি ভি এন এন হলটিই ভাড়া নিয়েছিলেন। সিনেমার নাম দিয়েছিলেন 'মঞ্জুশ্রী সিনেমা'। ১৯৪৮ থেকে ১৯৫৭ - ন'বছর সিনেমাটি চলেছিল। তবে, সবমিলিয়ে আর্থিক লাভ তেমন হয়নি বলেই শোনা যায়। ডাবল প্রোজেক্টর থাকায় 'বিজলী'র মত বিরতির দরকার হোত না। মূল ছবির আগে 'ডিজনি'র একটা ছোট রীল সবাই উপভোগ করতেন। 'Fall of Berlin', 'The Bicycle Thief" -এর মত ছবি দেখানো হয়েছিল। সমসাময়িক বাংলা বা হিন্দি ছবি আনতেন মণিবাবু। হলদিবাড়ির মানুষ 'পথের পাঁচালী' প্রথম দেখেন এই 'মঞ্জুশ্রী'তেই, দেখেন তখনকার জনপ্রিয় ছবি উদয়ের পথে', 'বসু পরিবার'। ছবি শুরুর আগে বা বিরতির সময় ব্যবসায়িক বিজ্ঞাপনের স্লাইড দেখানো হোত। জেনারেটর বসানো হয়েছিল বর্তমান রবীন্দ্রভবের গ্রীণ রুম যেখানে সেই অঞ্চলে। থিয়েটার স্টেজটি ব্যবহার হত মেয়েদের বসার জায়গা হিসাবে। ওখানে ছিল একেবারে পিছনের আসনগুলি । পর্দা ছিল উল্টো দিকে। লাইব্রেরী মেম্বাররা Concession পেতেন, দ্বিতীয় শ্রেণীর মূল্যে প্রথম শ্রেণীতে বসতেন। প্রথম শ্রেণীর জন্য গদি আঁটা চেয়ার ছিল।
‘মঞ্জুশ্রী'র পরে এল 'রূপকথা' একই হলে। মালিক ছিলেন দেওয়ানগঞ্জের পুনমচাঁদ আগরওয়ালা। 'রূপকথা' চলত সরকারী বিদ্যুতে। ১৯৫৭ থেকে '৬০ সাল পর্যন্ত চলেছিল। '৬০ সালে হলে আগুন লাগে। সে আগুনে লাইব্রেরীরও বেশ ক্ষতি হয়। এই অগ্নিকান্ডের কথা পি ভি এন এন লাইব্রেরী প্রসঙ্গে বলা হয়েছে। সিনেমার সঙ্গে পি ভি এন এন-এর সম্পর্কের এখানেই সমাপ্তি।
এরপর পূর্বপাড়ায় ভেরিলাল নামে এক মাড়োয়ারী ব্যবসায়ীর গুদাম ঘরে কয়েকজনের যৌথ মালিকানায় চালু হয় বীণা টকিজ। ওদলাবাড়ির দুলাল চন্দ্র ঘোষ ও তাঁর বন্ধুরা বীণা টকিজ চালাতেন। প্রায় দশ বছর, ১৯৬৪ থেকে ১৯৭৪ চলেছিল। সিনেমা শুরুর আগে ভারত সরকারের ডকুমেন্টারি ফিল্ম দেখানো হোত। ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের (১৯৬৫, ১৯৭১-৭২) পর এই ডকুমেন্টারি প্রদর্শন বাধ্যতামূলক ছিল।
১৯৭৮ সালে পোস্ট অফিসের পূর্ব দিকে পৌরসভার দক্ষিণে অস্থায়ী শেড- ঘর করে চালু হয় মঞ্জুরী সিনেমা। এটি চলেছিল ১৯৭৮ থেকে ১৯৯০ পর্যন্ত। মালিক ছিলেন পশ্চিমপাড়া নিবাসী পরিমল দত্ত।
‘মঞ্জুশ্রী’র অবস্থানেই ‘শ্রীমা' সিনেমা চালু হয় ২৭.১২.১৯৯১ তারিখে। এটি মেখলিগঞ্জ মহকুমার একমাত্র সিনেমা হল। আসন সংখ্যা ৫০০। ১৯৯১-এ এঁরা প্রমোদকর দেন ১৭৮৭২ টাকা। আইনগত কারণে ২০০৭-এর শেষ দিক থেকে ‘শ্রীমা' বন্ধ হয়ে আছে। কর্তৃপক্ষ আশা করেন অল্প কিছুদিনের মধ্যে সিনেমাটি আবার চালু হবে।
সিনেমা প্রসঙ্গে পাঠককে দু'একটি বিষয় জানানো যেতে পারে। চল্লিশের দশকে সেন্ট্রাল এক্সাইজের কর্মচারী ছিলেন কেশব চন্দ্র ভট্টাচার্য, থাকতেন ডানকান ব্রাদার্সের কোয়ার্টাসে। তুফানগঞ্জ থেকে আসা এই ফর্সা সুপুরুষ মানুষটি ভালো অভিনেতা ছিলেন। সিনেমায় অভিনয়ের জন্য হলদিবাড়ি থেকে কোলকাতা চলে যান। হলদিবাড়ির আর এক মানুষ উৎপল বসু বিশাল দেহাকৃতির জন্য দৃষ্টি আকর্ষণ করতেন। চল্লিশের দশকে ইনিও একাধিক সিনেমায় অভিনয় করেছেন, যার অন্যতম প্রেমেন্দ্র মিত্রের 'হানাবাড়ি'। দেবীপ্রসন্ন নিয়োগী, যিনি 'ক্রান্তি সংঘে'র অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সংগঠক ছিলেন, তাঁর প্রসঙ্গে অন্যত্র কিছু কথা বলা হয়েছে। তিনি অনেকগুলি সিনেমায় অভিনয় করেছেন। এগুলির মধ্যে আছে আলাউদ্দিন, কাবুলিওয়ালা, নতুন ইহুদি (পরিচালনা: সলিল সেন), গঙ্গা (পরি: রাজেন তরফদার), হাঁসুলি বাঁকের উপকথা (পরি: তপন সিংহ), লৌহকপাট, সমাপ্তি (তিন কন্যা : সত্যজিৎ রায়), বাঘিনী (পরি: বিজয় সেন)। এঁরা সবাই প্রয়াত, সর্বশেষ দেবীপ্রসন্ন। বর্তমানে ছোট পর্দায় অভিনয় করছেন ('আকাশ বার্তা ও "জি' বাংলা এই দুটি চ্যানেলে) পশ্চিমপাড়ার সত্রাবিত পাল ।