
মূল কবিতা ঃ
মহাশোকে শোকাকুল কহিলা রাবণ---
“যে শয্যায় আজি তুমি শুয়েছ, কুমার
প্রিয়তম, বীরকুলসাধ এ শয়নে
সদা ! রিপুদলবলে দলিয়া সমরে,
জন্মভূমি রক্ষাহেতু কে ডরে মরিতে?
যে ডরে, ভীরু সে মুঢ়; শত ধিক্ তারে!
তবু, বস, যে হৃদয়, মুগ্ধ মোহমদে
কোমল সে ফুল-সম। এ বজ্র আঘাতে,
কত যে কাতর সে, তা জানেন সে জন,
অন্তর্যামী যিনি; আমি কহিতে অক্ষম।
হে বিধি, এ ভবভূমি তব লীলাস্থলী: -
পরের যাতনা কিন্তু দেখি কি হে তুমি
হও সুখী? পিতা সদা পুত্ৰদুঃখে দুঃখী --
তুমি হে জগৎ-পিতা, এ কি রীতি তব?
হা পুত্র! হা বীরবাহু বীরেন্দ্র-কেশরী!
কেমনে ধরিব প্রাণ তোমার বিহনে?”
এইরুপে আক্ষেপিয়া রাক্ষস-ঈশ্বর
রাবণ, ফিরায়ে আঁখি, দেখিলেন দূরে
সাগর-মকরালয়। মেঘশ্রেণি যেন
অচল, ভাসিছে জলে শিলাকুল, বাঁধা
দৃঢ় বাঁধে। দুই পাশে তরঙ্গ-নিচয়,
ফেণাময়, ফণাময় যথা ফণিবর,
উথলিছে নিরন্তর গম্ভীর নির্ঘোষে।
অপূর্ব-বন্ধন সেতু, রাজপথ-সম
প্রশস্ত বহিছে জলস্রোতঃ কলরবে,
স্রোতঃ-পথে জল যথা বরিষার কালে।
অভিমানে মহামানী বীরকুলষর্ভ
রাবণ, কহিলা বলী সিন্ধু পানে চাহি;—
“কী সুন্দর মালা আজি পরিয়াছ গলে,
প্রচেতঃ! হা ধিক্, ওহে জলদলপতি!
এই কি সাজে তোমারে, অলঙ্ঘ্য, অজেয়
তুমি? হায়, এই কি হে তোমার ভূষণ,
রত্নাকর? কোন্ গুণে, কহ দেব, শুনি,
কোন গুণে দাশরথি কিনেছে তোমারে?
প্রভঞ্জন বৈরী তুমি; প্রভঞ্জন-সম
ভীম পরাক্রমে। কহ, এ নিগড় তবে
পর তুমি কোন্ পাপে? অধম ভালুকে
শৃঙ্খলিয়া জাদুকর, খেলে তারে লয়ে;
কেশরীর রাজপদ কার সাধ্য বাঁধে
বীতংসে? এই যে লঙ্কা, হৈমবতী পুরী,
শোভে তব বক্ষঃস্থলে, হে নীলাম্বুস্বামি,
কৌস্তুভ রতন যথা মাধবের বুকে,
কেন হে নির্দয় এবে তুমি এর প্রতি?
উঠ, বলি; বীরবলে এ জাঙাল ভাঙি,
দূর কর অপবাদ; জুড়াও এ জ্বালা,
ডুবায়ে অতল জলে এ প্রবল রিপু।
রেখো না গো তব ভালে এ কলঙ্ক-রেখা,
হে বারীন্দ্র, তব পদে এ মম মিনতি।"
উৎস: মাইকেল মধুসূদন দত্ত রচিত বাংলা সাহিত্যের কালজয়ী প্রকাশ 'মেঘনাদবধ কাব্যের প্রথম সর্গের অন্তর্ভুক্ত পাঠ্যাংশে গৃহীত ‘বীরবাহুর মৃত্যুতে রাবণ’ শীর্ষক অংশটি।
>> প্রশ্ন উত্তর <<
শব্দার্থ:
নিগড় -- বেড়ি, শৃঙ্খল। [সং. নি + √ গড়্ + অ]
বীতংস -- জাল, ফাঁদ। [সং. বি + √ তন্স্ + অ, বিকল্পে বী]
রিপু -- শত্রু
১) কমবেশি ১৫টি শব্দে উত্তর দাওঃ- [ FM: 1]
ক) "পিতা সদা পুত্ৰদুঃখে দুঃখী --/ তুমি হে জগৎ-পিতা, এ কি রীতি তব?"-- কে বলেছিল এই কথা? কেন বলেছিল?
উত্তর: বীরবাহুর মৃত্যুর শোকে এই কথা রাবণ করেছিল। তিনি শোকে কাতর হয়ে জগৎ-পিতা অর্থাৎ সৃষ্টিকর্তাকে বলেছিলেন যে পিতা সবসময় পুত্রের দুঃখে কষ্টে দুঃখী হয়, তাহলে জগৎ-পিতা তার সন্তানসম মানুষদের দুঃখ দেয় কী করে!
খ) "কোন গুণে দাশরথি কিনেছে তোমারে?"-- বক্তা কে? এখানে "দাশরথি" কে?
উত্তর: বক্তা রাবণ। এখানে দাশরথি বলতে রাজা দশরথের পুত্র রামকে বোঝানো হয়েছে। রাম সমুদ্রের উপরে পাথর দিয়ে সেতু বানিয়ে লঙ্কায় পৌঁছেছিল সীতাকে উদ্ধার করতে।
২) কমবেশি ৫০টি শব্দের মধ্যে উত্তর দাও: [ FM-3 ]
ক) "অধম ভালুকে শৃঙ্খলিয়া জাদুকর, খেলে তারে লয়ে; / কেশরীর রাজপদ কার সাধ্য বাঁধে
বীতংসে?"-- এই কথা কে কাকে বলেছে? বক্তার এই কথার অন্তর্নিহিত অর্থ কী?
উত্তর: রাবণ এই কথা বলে সমুদ্রকে তিরস্কার করছিল। রাম সমুদ্রের ওপর পাথরের সেতু বানিয়ে লঙ্কায় সীতাকে উদ্ধার করতে এলে বীরবাহুর মৃত্যু হয়েছিল। তাই রাবণ সমুদ্রকে বলছিল যে সমুদ্র যেন জাদুকের শিকল বাধা ভালুক। রাম যেন সমুদ্রকে পাথরের শিকল দিয়ে বেঁধেছে। এবং রামের কথাতেই সে যেন নাচছে। কিন্তু সমুদ্র তো বরুন দেবতা। তাকে হতে হবে সিংহের মত বীর। যাতে কারও সাধ্য নাহয় তাকে বাঁধার।