Ticker

6/recent/ticker-posts

Class 9 | নগরলক্ষ্মী (nagarlakshmi) | রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর | প্রশ্ন উত্তর


দুর্ভিক্ষ শ্রাবস্তীপুরে যবে
           জাগিয়া উঠিল হাহারবে,
বুদ্ধ নিজভক্তগণে                  শুধালেন জনে জনে,
         "ক্ষুধিতেরে অন্নদানসেবা
         তোমরা লইবে বল কেবা?'

         শুনি তাহা রত্নাকর শেঠ
         করিয়া রহিল মাথা হেঁট।
কহিল সে কর জুড়ি,              "ক্ষুধার্ত বিশাল পুরী,
         এর ক্ষুধা মিটাইব আমি
         এমন ক্ষমতা নাই স্বামী!'

         কহিল সামন্ত জয়সেন,
         "যে আদেশ প্রভু করিছেন
তাহা লইতাম শিরে               যদি মোর বুক চিরে
         রক্ত দিলে হ'ত কোনো কাজ--
         মোর ঘরে অন্ন কোথা আজ!' 

         নিশ্বাসিয়া কহে ধর্মপাল,
         "কী কব, এমন দগ্ধ ভাল,
আমার সোনার খেত              শুষিছে অজন্মা-প্রেত,
         রাজকর জোগানো কঠিন--
         হয়েছি অক্ষম দীনহীন।' 

         রহে সবে মুখে মুখে চাহি,
         কাহারো উত্তর কিছু নাহি।
নির্বাক্‌ সে সভাঘরে               ব্যথিত নগরী-'পরে
         বুদ্ধের করুণ আঁখি দুটি
         সন্ধ্যাতারাসম রহে ফুটি।

         তখন উঠিল ধীরে ধীরে
         রক্তভাল রাজনম্রশিরে
অনাথপিণ্ডদসুতা                   বেদনায় অশ্রুপ্লুতা,
         বুদ্ধের চরণরেণু লয়ে
         মধু কণ্ঠে কহিল বিনয়ে--

         "ভিক্ষুণীর অধম সুপ্রিয়া
         তব আজ্ঞা লইল বহিয়া।
কাঁদে যারা খাদ্যহারা              আমার সন্তান তারা,
         নগরীরে অন্ন বিলাবার
         আমি আজি লইলাম ভার।' 

         বিস্ময় মানিল সবে শুনি--
         "ভিক্ষুকন্যা তুমি যে ভিক্ষুণী!
কোন্‌ অহংকারে মাতি   লইলে মস্তকে পাতি
         এ-হেন কঠিন গুরু কাজ!
         কী আছে তোমার কহো আজ।'

         কহিল সে নমি সবা-কাছে,
         "শুধু এই ভিক্ষাপাত্র আছে।
আমি দীনহীন মেয়ে               অক্ষম সবার চেয়ে,
         তাই তোমাদের পাব দয়া--
         প্রভু-আজ্ঞা হইবে বিজয়া।

         "আমার ভাণ্ডার আছে ভরে      
         তোমা-সবাকার ঘরে ঘরে।
তোমরা চাহিলে সবে              এ পাত্র অক্ষয় হবে।
         ভিক্ষা-অন্নে বাঁচাব বসুধা--
         মিটাইব দুর্ভিক্ষের ক্ষুধা।'

 ========


রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নগরলক্ষ্মী কবিতার : একটি আলোচনা



মানবীর গর্ভজাত হলেই তাকে মানুষ বলা যায় না। মানুষ হিসেবে জন্ম নিলেই কেউ মানুষ হয়ে যায় না। মানুষের সারবস্তু হল তার হৃদয়। আর হৃদয়ের সম্পদ হল মানবীয় গুণাবলী। মানবতা, ভালোবাসা, দয়া, মায়া পূর্ণ অন্তরাত্মাই মানুষকে পূর্ণতা দান করে। এইগুলিই হল আসল সম্পদ। 

কিন্তু মানব সভ্যতার বিবর্তনের সাথে সাথে মানুষের মধ্যকার দোষগুলির বিলুপ্তি না হয়ে আজও মানুষের মনের কালকুঠুরিতে থেকে গিয়েছে। প্রেম ভালোবাসা মমত্ববোধ সততা সহমর্মিতার অন্তঃস্থলে শক্ত খুঁটি হয়ে বসে আছে লোভ লালসা হিংসা ঘৃণা আর ক্ষমতার দম্ভ। মানুষ আজ ষড়রিপুর দাস। আপন লাভ লোকসানের হিসেব কষতে কষতে মানুষ এক ভয়ঙ্কর আত্মকেন্দ্রিক জীবে পরিণত হয়েছে। নিজের স্বার্থটুকু ছাড়া আর কিছু ভাবছে না সে। অপরকে আপন ভাবা বা আপন করে নেওয়া এখন অতীত। সর্বত্র এক যান্ত্রিক জীবন। অপরের জন্য নিজের সবটুকু বিলিয়ে দেওয়ার মত হৃদয়ের বড় অভাব। অপরের জন্য নিজেকে উৎসর্গ করার কথা আজ হাস্যকর শোনায়। আত্মার সেই টানটাই উধাও। "বসুধৈব কুটুম্বকম" অর্থাৎ গোটা পৃথিবী আমাদের আত্মীয়, এই বাক্যটি উপনিষদের বাণী হয়েই রয়ে গেল। আত্মার সাথে অপরাত্মার টান ছাড়া তো আত্মীয় হওয়া যায় না। 

এইখানেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের "নগরলক্ষ্মী" কবিতা যেন ভীষণরকম প্রাসঙ্গিক। অসহায়ের সহায়, আর্তের সেবক হওয়ার মহৎ বার্তা দেয় এই কবিতা। রক্তের সম্পর্ক ছাড়াও যে প্রেমের অস্তিত্ব তার কথা বলে এই কবিতা। "কাঁদে যারা খাদ্যহারা, আমার সন্তান তারা", এই গভীর মমত্ববোধের কথা স্মরণ করিয়ে দেয় কবিতাখানি। 

"নগরলক্ষ্মী" কবিতাটি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের "কথা ও কাহিনী" নামক আখ্যানমূলক কাব্যগ্রন্থের অন্তর্গত। এই গ্রন্থের কবিতাগুলি ন্যারেটিভধর্মী বা আখ্যানমূলক। কবিতাগুলির মধ্যে থাকা কাহিনীগুলো ঐতিহাসিক। এই সকল কবিতার রাজ্যে আগমন ঘটেছে বৌদ্ধযুগের ইতিহাস, মহারাষ্ট্রের ইতিহাস, রাজস্থানের ইতিহাস ও পাঞ্জাবের ইতিহাসনির্ভর নানান ঘটনা। বৌদ্ধ যুগের কাহিনীগুলির কবি সংগ্রহ করেছেন বিভিন্ন বৌদ্ধগ্রন্থ যেমন ‘অবদানশতক’, ‘মহাবস্তুবদান’, ‘দিব্যাবদানমালা’, ‘কল্পদ্রুমাবদান' ইত্যাদি থেকে। রবি ঠাকুরের ভাষায়, "এই গ্রন্থে যে সকল বৌদ্ধকথা বর্ণিত হইয়াছে তাহা রাজেন্দ্রলাল মিত্র সংকলিত নেপালী বৌদ্ধ সাহিত্য সম্বন্ধীয় ইংরাজী গ্রন্থ হইতে গৃহীত।" "নগরলক্ষ্মী" কবিতাটির কাহিনী  ‘কল্পদ্রুমাবদান থেকে নেওয়া। এবং আমরা এই কবিতায় গৌতম বুদ্ধের প্রত্যক্ষ উপস্থিতি দেখতে পাই। বৌদ্ধ ধর্মের মহান জীবনাদর্শ, সেই সময়ের মানুষের আত্মোৎসর্গমূলক নানান অধ্যায় কবিকে মুগ্ধ করেছিল। তিনি প্রাচীন এই বৌদ্ধসাহিত্যের কাহিনীগুলোয় গভীর অর্থ ও ব্যঞ্জনা সন্ধান করে বর্তমানের সাথে মিলিয়ে নতুন ভাবে তাকে বাত্ময় করে তুলতে চেয়েছেন।  

দুর্ভিক্ষপীড়িত শ্রাবস্তীপুরে ভগবান বুদ্ধের অন্নদান সেবার আবেদনে তার ধনী ক্ষমতাবান ভক্তবৃন্দ কেউই সেদিন এগিয়ে আসেননি। তারা নাকি এতটাই অক্ষম। আসলে আমরা যতই মুখে ধর্মের বাণী বলি আমাদের কাজে তা খুব কমই প্রতিফলিত হয়। জীবসেবাই শিবসেবার বাণী মুখেই শুধু মানি। অন্যান্য জীব দূরের কথা, ক্ষুধার্থ মানুষের মুখে দুটো ভাত তুলে দিতে চাই না। আমরা এতটাই নির্দয় আর কঠিন হৃদয়ের। নিজেকে বুদ্ধের অনুসরণকারী ধার্মিক পরিচয় দিয়ে ধর্মের আদর্শ আর বাণী ভুলে যাওয়ার এই অসামঞ্জস্যকেই 'নগরলক্ষ্মী' কবিতা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়। 

আমরা পার্থিব সম্পদে যতই ধনী হই না কেন, অন্তরে আমরা ঠিক ততটাই দরিদ্র। আমাদের বিরাট চাহিদার কাছে ক্ষুধার্থের মুখে দুটো অন্নদানও অপচয় বলে মনে হয়। ধনীর আরও ধনের ক্ষুধা যেন দুর্ভিক্ষপীড়িত ক্ষুধার্থর চেয়েও বেশি। আজও এই অবস্থার পরিবর্তন ঘটেনি। তাই 'নগরলক্ষ্মী' কবিতার এই কাহিনী ঐতিহাসিক হলেও মানুষের এই আচরণ আজও সমানভাবে প্রাসঙ্গিক। 

বুদ্ধের ধনী শিষ্যরা অর্থাৎ রত্নাকর শেঠ, সামন্ত জয়সেন, ধর্মপাল ইতাদি কেউই দুর্ভিক্ষপীড়িতদের অন্নদানের গুরুদায়িত্ব গ্রহণে সাহসী হলেন না। অথচ এই সঙ্কটকালে আলোকবর্তিকা হাতে এগিয়ে এল অনাথপিণ্ডদের কন্যা ভিক্ষুণী সুপ্রিয়া। সে ভিক্ষুণী হলেও তার হৃদয় দয়ার সম্পদে সমৃদ্ধ। তার উদার হৃদয়ের উপলব্ধি "কাঁদে যারা খাদ্যহারা, আমার সন্তান তারা।" 

এরকম ক'জন ভাবতে পারে! এই কবিতার কিন্তু দেখা গেল পার্থিব ধনে ধনী হলেও অন্তর গুণহীন শূণ্য হতে পারে। মুখে বুদ্ধের অনুসরণকারী হলেও বুদ্ধের ধর্মের বাণী আদর্শ পালন সকলের দ্বারা হয় না। এখানে লক্ষ্যণীয় যে সুপ্রিয়া নামের সেই ভিক্ষুণী সমাজের দুর্বলতর শ্রেণীর প্রতিনিধি। শুধু তাই নয় সে একজন সাধারণ নারী। অথচ সে তার সামান্য ভিক্ষান্ন দিয়ে সমগ্র শ্রাবস্তী নগরীর দুর্ভিক্ষপীড়িত মানুষকে ক্ষুধার অন্ন জোগান দেবার সংকল্প গ্রহণ করছে। বুদ্ধের অনুপ্রেরণায় তার এক অসাধারণ মানসিক উত্তরণ ঘটেছে। এই উত্তরণ হলে মানুষ চরম স্বার্থত্যাগ করতেও পিছপা হয় না। এমনকী পরের জন্য নিজের জীবনকে ত্যাগ করতেও দ্বিধা করে না। মানুষ হিসেবে তারা মহত্ত্বর হয়ে উঠতে পারে। দীনহীনা এক ভিক্ষুণীর রমণীর হৃদয়ের সর্বস্বদানে পূর্ণ হয়ে উঠতে পারে দুর্ভিক্ষপীড়িত নগরীর অন্নদান সেবার ভিক্ষার ঝুলি। 



*** Note: ষড়রিপু--- (সংস্কৃত: षड्रिपु, আক্ষরিক অর্থ: ছয় শত্রু) বা ষড়্ রিপু বা অরিশদবর্গ হল ভারতীয় দর্শনমতে মানব মনের ছয়টি শত্রু। এগুলো হল - কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, মদ ও মাৎসর্য। শব্দটি সংস্কৃত “ষট্”-এর সাথে 'রিপু' যুক্ত হয়ে গঠিত। ষড়রিপুর নেতিবাচক বৈশিষ্ট্য মানুষকে মোক্ষ লাভে বাধা প্রদান করে।


=====================================


>> শব্দার্থ :
শির -- মাথা, মস্তক। হেঁট -- অবনত। মাথা হেঁট -- লজ্জায় মাথা নীচে করা। দগ্ধ -- পোড়া। অক্ষম -- ক্ষমতা নাই যা'র, incapable, অসমর্থ। ভাল -- কপাল। রক্তভাল -- লজ্জায় লাল হওয়া কপাল। ভাণ্ডার -- ভাঁড়ার, গোলাঘর। অক্ষয় -- অবিনশ্বর, ক্ষয় নাই যা'র,



=====================================


 >> প্রশ্ন উত্তর <<

     
১) কমবেশি ১৫টি শব্দে উত্তর দাওঃ- [ FM: 1]

ক) "বুদ্ধ নিজভক্তগণে শুধালেন জনে জনে।"-- কোথায় দুর্ভিক্ষ হয়েছিল? বুদ্ধ জনে জনে কী জীজ্ঞেস করলেন?
উত্তর: শ্রাবস্তীপুরে দুর্ভিক্ষ হয়েছিল। এইসময় বুদ্ধ সবাইকে জীজ্ঞেস করেছিলেন যে ক্ষুধার্তদের খাদ্য দান করার ভার কে নেবে।

খ) "কহিল সে কর জুড়ি'।"-- বক্তা কে? সে হাত জোড় করে কী বলেছিল?
উত্তর: রত্নাকর শেঠ বুদ্ধকে বলেছিল যে দুর্ভিক্ষের দিনে অতবড় রাজ্যের সকল মানুষের ক্ষিদে মেটানোর ক্ষমতা তার নেই। 

২) কমবেশি ৩০টি শব্দে উত্তর দাওঃ- [ FM: 2]

ক) "নিঃশ্বাসিয়া কহে ধর্মপাল।" -- ধর্মপাল চিন্তিত হয়ে  বুদ্ধকে তার অক্ষমতার কথা কীভাবে জানিয়েছিল?
উত্তর: ধর্মপাল বুদ্ধকে বলেছিল যে তার পোড়া কপাল। ভাগ্য এতটাই খারাপ যে তার সোনার ফসলের ক্ষেত শুকিয়ে গিয়েছে। দুর্ভিক্ষের প্রেত তার ক্ষেতের ফসলের রস শুষে নিয়েছে। ফসল না হওয়ায় সে রাজার কর (tax) দিতে পারেনি। তার এখন আর কোনও ক্ষমতা নেই। সে এখন এক দীনহীন দরিদ্র মানুষ। তাই তার পক্ষে শ্রাবস্তীপুরের সেই দুর্ভিক্ষের দিনে ক্ষুধার্তদের খাদ্য দিয়ে সেবা করা সম্ভব নয়।

৩) কমবেশি ৫০টি শব্দের মধ্যে উত্তর দাও: [ FM-3 ]

ক) "বিস্ময় মানিল সবে শুনি।"-- সবাই কেন বিস্মিত হয়েছিল? বিস্মিত হয়ে কী বলেছিল?
উত্তর: শ্রাবস্তীপুরের দুর্ভিক্ষে নগরের ক্ষুধার্তদের অন্ন-খাদ্য দিয়ে সেবা করতে কেউই সক্ষম নয় বলেছিল। তখন ভিক্ষুণী সুপ্রিয়া বলেছিল যে নগরের সকলকে অন্ন দেওয়ার ভার সে নিতে চায়। একজন সাধারণ ভিখিরিনীর খাদ্য-অন্নের ভার নেওয়ার কথায় সকলে বিস্মিত হয়েছিল। তারা বলেছিল যে সুপ্রিয়া তো ভিখারিনী। তার কিছুই নেই। সে কোন অহংকারে এই ভার নিতে চায়।