Ticker

6/recent/ticker-posts

পাখিরা গান গায় || হুয়ান র‍্যামোন হিমেনেথ || বাংলা দ্বিতীয় ভাষা || সাহিত্য সম্ভার || WBBSE

 



>>> ***পাখিরা গান গায়***

------- হুয়ান র‍্যামোন হিমেনেথ

=====================



>> কবিতা হল আমাদের এই সাধারণ পার্থিব জীবন অতিক্রমের একটি রূপ। চেনা বস্তুগত জগৎ ছাড়িয়ে শাশ্বত ও চিরন্তন এক পবিত্র গভীরতায় চলে যাওয়া। নোবেল সাহিত্য পুরস্কারে সাম্মানিত কবি হুয়ান র‍্যামোন হিমেনেথের কবিতা আমাদের সেই প্রকৃতি, আলো এবং গানের মধ্যে সংযোগ স্থাপন করার কথা বলে। যার কবিতায় পাখি ফুল আর প্রকৃতির নানান উপাদান একটি হারিয়ে যাওয়া, ঐশ্বরিক আদিম সত্য পবিত্র স্বর্গীয় বাস্তবতাকে মূর্ত করে। কবি এখানে আমাদের সাধারণ অভিজ্ঞতার বাইরে লুকানো সত্যকে উপলব্ধি করেছেন। "অন্য রঙ"-এর ধারণা হল একটি আধ্যাত্মিক বা ভুলে যাওয়া স্বর্গের প্রতীক। সেই স্বর্গ যেখানে আত্মা বাঙ্ময় তার পবিত্রতায়। 


>>

"সারা রাত জুড়ে / পাখিরা / আমাকে শোনালে তাদের রঙের গান।"


হিমেনেথ বিশ্বাস করেন যে কবিতা কেবল শব্দ সম্পর্কে নয় বরং এ যেন এক ঐশ্বরিক অনুগ্রহের একটি অবস্থা। 


পাখিরা তাদের রঙের গান গাইতে গাইতে অদেখা অথবা ভুলে যাওয়া এক সত্যের উদ্ঘাটন ঘটায়। সাধারণ রঙ নয় বরং আরও গভীর কিছু, সাধারণ মানুষের উপলব্ধির বাইরে। অচেনা এক অতীত, এক অন্য স্বর্গের কথা শোনায়। প্রকৃতি যেন সেই লুকানো সত্যের বার্তাবাহক বলে কবি মনে করেন। প্রকৃতি যেন রঙ পাখি গান --- এই সমস্ত উপাদানের মাধ্যমে আমাদের আত্মার সাথে তার সংযোগ করার বার্তা দেয়। 



>>

"এই রং নয় / সূর্যোদয়ের ঠান্ডা হাওয়ায় / তাদের ভোরের ডানার।"


সকালের আলো সাধারণ উপলব্ধি। পার্থিব সতেজতা ও দৃশ্যমান বিশ্বের প্রতীক। হিমেনেথের কবিতা সেই বাস্তব জগতের বাইরে বিশুদ্ধ সত্তার (অস্তিত্ব, চেতনা, কনশাসনেশ) রাজ্যে যাওয়ার চেষ্টা করে। কবি এমন একটি অবস্থার কথা বলতে চাইছেন যেখানে আমাদের এই রূপান্তর একটি সম্পূর্ণ বর্তমান। যা অতীত এবং ভবিষ্যতকে ক্ষণিকের প্রগতিশীল পরমানন্দে একত্রিত করে। কিন্তু কবি পাখির এই উপরিভাগের সৌন্দর্যে আগ্রহী নন। বরং গভীরতর কিছুতে আগ্রহী।



>>

"এই রং নয় / সূর্যাস্তের অগ্নিবর্ণে / তাদের সান্ধ্যবুকের।"


এই রঙ সূর্যাস্তের মৃতপ্রায় আলোকে নির্দেশ করে। হিমেনেথ আধ্যাত্মিক জাগরণের রূপক হিসাবে আলোকে দেখেছিলেন। সূর্যাস্তের পার্থিব সৌন্দর্যকে তিনি প্রত্যাখ্যান করে বোঝাতে চেয়েছেন যে সকাল এবং সন্ধ্যা উভয়ের আলোর বাইরেও কিছু আছে। এক অন্য ধরণের রঙ। যা আত্মার গভীরের উপলব্ধির কথাকে অতীতের পাতা থেকে স্মরণ করায়। 



>>

"এই রং নয় / রাত্তিরে নিবে যাওয়া / প্রত্যহ চেনা ঠোঁটের / যে রকম নেবে (নেভে/fade)/  ফুল ও পাতার প্রত্যহ চেনা রং।"


প্রতিদিনের রং রাতে একসময় ম্লান হয়ে যায়। কিন্তু হিমেনেথের কবিতা থেকে বোঝা যায় সাধারণ আলোর অনুপস্থিতিতে সত্যিকারের সৌন্দর্য ও চিরন্তন সত্যের উদ্ভব ঘটে। কবিতাকে সময় এবং স্থানের বাইরে বিদ্যমান এক বার্তাবাহক হিসাবেই কবি দেখেছিলেন। কবি এমন এক সত্যের সন্ধান করছেন যা দিন, রাত বা প্রকৃতির কোনো সাধারণ চক্রে আবদ্ধ নয়।


>>

"অন্য বর্ণ / আদিম স্বর্গ / এ জীবনে যাকে হারিয়ে ফেলেছে মানুষ।"


কবি অনুভব করেছেন এই "অন্য বর্ণ" শাশ্বত, ঐশ্বরিক এবং হারিয়ে যাওয়া কিছুর প্রতীক। প্রথম স্বর্গ, যা পাখি ও ফুলেরা খুব গভীরভাবে চেনে।


"আদিম স্বর্গ " মানুষের কলুষতার আগের সময়কে বোঝায়। আমাদের অতীতের অস্তিত্বের এক বিশুদ্ধ অবস্থা যা কেবল এই প্রকৃতিই মনে রেখেছে। প্রকৃতি তার অন্তরে ফুল রঙ পাখিদের মধ্য দিয়ে এক সংকেতে একে ধরে রেখেছে। যা সাধারণভাবে মানুষের অবোধ্য। হিমেনেথ বিশ্বাস করেন যে আধুনিক মানব সেই প্রকৃতির সাথে তার ঐশ্বরিক সংযোগ হারিয়ে ফেলেছে। আমরা কবির এই কাব্যিক উচ্চারনের মাধ্যমে বুঝতে পারি যে মানুষ একটি উচ্চতর বাস্তবতা সম্পর্কে তাদের সরলতা এবং সচেতনতা হারিয়েছে। কিন্তু প্রকৃতি তা ভোলে না। তার নানান উপাদানের বিশুদ্ধতায় সেই চিরন্তনীকে মনে রাখে।



>>

"সেই যে স্বর্গ / ফুল ও পাখিরা / শুধু যাকে চেনে গভীর---"


ফুল পাখি আর তাদের রঙের গান সেই আদিম বিশুদ্ধতা, শাশ্বত এবং ঐশ্বরিক সংযোগের প্রতিনিধিত্ব করে। এর অর্থ হ'ল প্রকৃতি একটি গভীর পবিত্র শাশ্বত জ্ঞান ধারণ করে যা মানুষ আর উপলব্ধি করতে পারে না। সেই স্বর্গের সূত্র ধরা রয়েছে ফুল-পাখি আর তাদের রঙে-গানে। 


>>

"ফুল ও পাখিরা / সুগন্ধে আসে যায় / সৌরজগতে ঘুরে ঘুরে তারা ওড়ে।"


প্রকৃতি মুক্ত, প্রবহমান এবং অবিচ্ছিন্ন। পার্থিব চাওয়া পাওয়া ও উদ্বেগের দ্বারা ভারাক্রান্ত মানুষের অন্যদিকে-- বিপরীতে। ফুল আর পাখিদের রূপকে কবি বোঝাতে চাইছেন যে প্রকৃতি এক ধরণের স্বাধীনতা এবং প্রজ্ঞার মূর্ত প্রতীক যা এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সর্বত্র বিস্তৃত। 



>>

"অন্য বর্ণ, / অবিনশ্বর স্বর্গ / মানুষ সেখানে স্বপ্নে ভ্রমণ করে।"


"অবিনশ্বর স্বর্গ " সময়ের পরিধির বাইরে এক আধ্যাত্মিক সত্যকে প্রকাশ করছে। এর অর্থ এই যে কবিতা এবং স্বপ্ন হ'ল একমাত্র উপায় যা মানুষ এই হারানো স্বর্গের সাথে পুনরায় সংযোগ করতে পারে।


>>

"সারা রাত জুড়ে / পাখিরা / আমাকে শোনালে তাদের রঙের গান।"


কবি যেন সারা রাত ধরে একটি রহস্যের উদ্ঘাটন অনুভব করছেন। এই কথাগুলির পুনরাবৃত্তি প্রকৃতির রহস্যাবৃত সেই সংকেতময়তা উদঘাটনের দৃঢ় বিশ্বাসের কথা জানান দিচ্ছে যেন। কারণ এই "অন্য রঙ" লুকানো সত্যের প্রতীক যা কেবল স্বপ্ন বা কবিতার মতো গভীর সচেতনতার মুহুর্তগুলিতে দৃশ্যমান হয়।



>>

"অন্য বর্ণ / যা শুধু রয়েছে তাদের অন্য জগতে / শুধু রাত্তিরে নিয়ে আসে তারা হাওয়ায়।"


পাখি সেই কবিতার দূত যা দৃশ্যমান ও অদৃশ্য দুই জগতের সংকেতের আদানপ্রদান করে। প্রকৃতির এই উপাদান যেন কবির সাথে সাথে পাঠকের উপলব্ধির সন্ধানে ঘুরছে। প্রকৃতি যেন নিজেই একটি লুকানো সত্য উপস্থাপন করছে তাদের কাছে, যারা শুনতে ইচ্ছুক।



>>

"কয়েকটি রং / আমি তো দেখেছি অতি জাগ্রত / জানি আমি তারা কোথায়।"


কবি জোর দিয়ে বলেছেন যে এই "অন্য রঙ" কেবল স্বপ্ন নয় বরং বাস্তব কিছু। যা এই প্রকৃতির মাঝেই সযতনে রক্ষিত। অর্থাৎ কবি এমন কিছু উপলব্ধি করতে পারেন যা অন্যরা পারে না। যারা ভুলে গেছে এই অন্য রঙের সাংকেতিক বার্তা কবি চাইছেন এই কবিতার মাধ্যমে তাদের কাছে তা' পৌঁছে যাক। 



>>

"জানি আমি ঠিক কখন / পাখিরা আসবে / রাত্রে আমায় শোনাতে তাদের গান।"


কবির সাথে প্রকৃতির এই লুকিয়ে থাকা বাণীর গড়ে উঠেছে এক গভীর সম্পর্ক। কবি সক্রিয়ভাবে এই অভিজ্ঞতার অংশ। তিনি কেবল একজন সাধারণ  পর্যবেক্ষক নন।


>>

"জানি আমি ঠিক কখন / পেরিয়ে বাতাস পেরিয়ে বন্যা / পাখিরা গাইবে গান। "


এই শেষ লাইনটি ইঙ্গিত দেয় যে কবি প্রকৃতির সর্বজনীন গানের সাথে তাল মিলিয়ে আছেন। অর্থাৎ এই কবিতা পাঠককে নিয়ে যায় এমন এক জায়গায়, যেখানে বাতাস, ঢেউ, পাখি ও রঙ সবকিছুই এক বৃহত্তর সত্যে মিশে যায়।






>>>>>>>

হুয়ান র‍্যামোন হিমেনেথ (১৮৮১-১৯৫৮) ছিলেন একজন স্প্যানিশ কবি যিনি কবিতায় বিশুদ্ধতার সাধনার জন্য পরিচিত ছিলেন। জন্ম মোগুয়ের, আন্দালুসিয়ায়। তিনি সাহিত্যে মনোনিবেশ করার জন্য আইন অধ্যয়ন ত্যাগ করেছিলেন, আধুনিকতা এবং রুবেন দারিও দ্বারা প্রভাবিত। ১৯৫৬ সালে তিনি সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন, কিন্তু এর কিছুদিন পরেই তার স্ত্রী জেনোবিয়া মারা যান, যার ফলে তার গভীর হতাশা দেখা দেয়।


তার একটি কবিতা সংকলন গ্রন্থে তিনি বলেছেন যে যে সত্যিকারের কবিতা হবে স্বতঃস্ফূর্ত ও নিখুঁত, "সবচেয়ে কম উপাদান" ব্যবহার করে। এই দর্শন তাঁর পরবর্তী রচনাগুলিতে প্রতিফলিত হয়েছে।


রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হিমেনেথকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিলেন। তিনি এবং জেনোবিয়া রবীন্দ্রনাথের বিশটি খণ্ড স্প্যানিশ ভাষায় অনুবাদ করেন এবং স্প্যানিশ ভাষাভাষী বিশ্বের সাথে তাকে পরিচয় করিয়ে দেন।


>> আলোচ্য "পাখিরা গান গায়" (Spanish: Los pájaros de yo sé dónde /লোস পাখারোস দে ইয়ো সে দোন্দে)। এটি "আলফার" (Alfar) পত্রিকার ৯০তম সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছিল। মন্তেভিদেও, ১৯৫২-৫৩ সালে।