শামুক
---- অনুপমা বসুমাতরি
[তরজমা: মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়]
একদিন ধানগাছের ফাঁকে ফাঁকে উপুড় প'ড়ে-থাকা শামুকদের /
আমি খালুইতে তুলে নিয়েছিলাম যতক্ষণ-না খালুই ভ'রে গিয়েছিল /
আর সেদ্ধ করার আগে ডেকচির ঢাকনি তুলে খুব খুশি হ'য়ে গিয়েছিলাম /
শামুকরা খোলার ভেতর তাদের আস্ত শরীরটাই গুটিয়ে নিয়েছিল /
আমি এক টিপুনিতেই ভেতর থেকে বার ক'রে এনেছিলাম সব মাংস আর মজ্জা /
মেঝের খাবার জায়গায়
খোলাগুলো ভেঙে গিয়েছিল মড়মড় ক'রে আর তার মধ্যে কেমন-একটা অদ্ভুত ছন্দ ছিল /
যার মধ্যে লুকিয়েছিল মরা শামুকগুলোর শোক তাপ বিলাপ।
সেই ছন্দটির উৎস হাতড়ে আমি এখন হামাগুড়ি দিয়ে বেড়াই /
সাগরের পারে-পারে, বেয়ে বেয়ে উঠি জলে-ডাঙায় /
হু হুয়াই ওঠে ঢেউয়ের আওয়াজ আর আমি তার কবলে প'ড়ে যাই /
আর বারে-বারে ভেসে-ভেসে উঠি
আশ্চর্যভাবে কোন্-এক অদৃশ্য হাত আমার শরীরটা তুলে নিলে /
এবার এক টিপুনিতেই নিংড়ে বার ক'রে নিলে আমার নিজের ভেতরটাকে।
বুক ভেঙে যাবার যন্ত্রণাতেই মড়মড় ক'রে ভেঙে যাচ্ছে আমার শরীরের খোলা /
আর সৃষ্টি হ'য়ে গেছে আরো এক নতুন বিলাপগাথার ছন্দ।
--------------------------------------------------------------
শামুক
--- অনুপমা বসুমতাৰী
তাহানি ধান গছৰ ফাকে ফাকে উবুৰি খাই থকা শামুকবোৰ
বুটলিছিলোঁ খালৈৰ ডিঙি নোপোৱালৈকে
আৰু সিজোৱাৰ আগেয়ে ঢাকনিবোৰ এৰুৱাই ৰং পাইছিলোঁ
কোচ খুৱাই সুমুৱাই নিয়া জিভাখন চাই
শোহা মাৰি উলিয়াই আনিছিলোঁ শাহ্, খোৱাৰ মজিয়াত
খোলাবোৰৰ মৰ্ মৰ্ শব্দত আছিল এটা অদ্ভূত ছন্দ
য’ত লুকাই আছিল মৃত শামুকবোৰৰ শোক!
সেই ছন্দৰ উৎস বিচাৰি এতিয়া মই চুচৰি ফুৰিছোঁ
সাগৰৰ পাৰে পাৰে, বগাই ফুৰিছোঁ জলত স্থলত
হু হুৱাই অহা ঢৌৰ কবলত পৰি বাৰে বাৰে উটিছোঁ ভাহিছোঁ
আশ্চৰ্যজনকভাৱে মোৰ শৰীৰটো বুটলি লৈছে এখন অদৃশ্য হাতে
শোহা মাৰি শূন্য কৰিছে মোৰ ভিতৰখন।
হৃদয় ভঙাৰ যন্ত্ৰণাত মৰমৰাই উঠিছে মোৰ শৰীৰৰ খোলা
আৰু সৃষ্টি হৈছে এটা নতুন শোক গাঁথাৰ ছন্দ।
--------------------------------------------------------------
Snails (Shaamuk)
---- Anupama Basumatary
[Translated by: Pradip Acharya]
Those days I picked the upturned snails
from among the stalks of growing grain
and filled my creel till the neck.
It was fun removing the shells
and watching their recoiling tongues
before I boiled them.
As I sucked the sap and threw the shells
they lay creaking on the floor
in a certain strange rhythm
that hid the agony of their dying.
Now I crawl around the sea-shores
clamber about on land and water
to look for the roots of that strange note
as the marauding waves
draw me back and fling me away.
Strangely, an unseen hand picks me up
sucks my sap and leaves me empty.
The shell of my body creaks
in the agony of the heart breaking
and makes the strange measure of a sad strain.
>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>
শামুক কবিতার অন্তর্নিহিত অর্থ:
অনুপমা বসুমাতরির কবিতা "শামুক" একটি শক্তিশালী ও গভীর লেখা যা পশু হত্যা, নারীদের প্রতি সহিংসতা, লিঙ্গ সমতার প্রসঙ্গে এক উচ্চকিত কাব্যিক উচ্চারণ। এই কবিতা শোষণ, সহিংসতা এবং সামাজিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে কথা বলে। এবং খাদ্যর জন্য প্রাণীহত্যার রূপকের মধ্য দিয়ে নারী শোষণের বিষয়টি তুলে ধরে। রূপকও এখানে সম্পূর্ণ রূপক নয়। শামুকের হত্যা আর শোষিত প্রান্তিক মানুষ ও নারী কোথাও গিয়ে যেন এক হয়ে গিয়েছে এই কবিতায়। কবিতাটির মাধ্যমে আমরা বুঝতে পারি যে লেখিকা কেবল শামুকের শিকারকে নিয়ে কথা বলেন না, বরং সমাজের শোষণকারী কাঠামোর বিরুদ্ধে এক গভীর প্রতিবাদ জানাচ্ছেন।
শামুক সংগ্রহের বিষয়টি একটি প্রাকৃতিক কাজ হিসেবে দেখা হলেও, এটি এক ধরনের সহিংসতা ও শোষণের রূপক। শামুকের খোলস থেকে মাংস-মজ্জা বের করে তা গরম করার প্রক্রিয়াটি পরিষ্কারভাবে দেখায় কিভাবে মনুষ্যজাতি অপর একটি সত্তাকে অবলীলায় শোষণ করে এবং তাকে নিয়ন্ত্রণ করতে চায়। এটি কেবল পশু হত্যার প্রতীক নয়, বরং মহিলাদের শরীর ও স্বাধীনতাকেও শোষিত করার একটি চিত্র।
কবি শামুকের হত্যার রূপকের মধ্য দিয়ে নারীর ওপর ঘটে চলা সামাজিক সহিংসতার একটি দুঃখগাথা লিখেছেন। “অদৃশ্য হাত” শব্দবন্ধটি এখানে সেই সমাজের শোষণকারী শক্তির প্রতীক। শামুকের প্রতি সহিংসতা, তার শরীরের প্রতি আক্রমণ, আসলে আমাদের সমাজে মহিলাদের প্রতি সহিংসতারই একটি রূপ। এটি এমন একটি পরিস্থিতি তৈরি করে যেখানে মহিলাদের দেহ, তাদের ইচ্ছা ও স্বাধীনতা, প্রতিনিয়ত সামাজিক নানা নিয়মের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়।
কবিতায় আরও বলা হয়েছে যে শামুকের চলাফেরা, "জল ও স্থল জুড়ে"--- এই বক্তব্য স্বাধীনতা ও লিঙ্গনিরপেক্ষ অবস্থানকে প্রকাশ করে। শামুকের খোলস ভেঙে বের হওয়া মাধ্যমে কবি এই পচে যাওয়া পুরনো লিঙ্গভিত্তিক সামাজিক কাঠামো থেকে মুক্তি পাওয়ার প্রতীক হিসেবে তুলে ধরেছেন। কবিতায় "অদৃশ্য হাত" দ্বারা শামুকটিকে তুলে নেওয়া, আসলে সেই শক্তি ও সমাজের কাঠামোকে প্রকাশ করে যা মহিলাদের শোষণ করে এবং তাদের স্বাধীনতাকে সীমাবদ্ধ করে রাখে।
মানব ও অন্য প্রাণীর মধ্যে থাকা শিকার শিকারি সম্পর্কের এই দ্বন্দ্ব যেন নারীপুরুষের বিভেদকে কবিতায় কঠোরভাবে প্রতিকী করে তুলতে সাহায্য করে। শামুকের শিকার এবং তার মাংস খাওয়ার প্রক্রিয়া আসলে একটি সহিংসতা এবং শোষণের চিত্র। এটি আমাদের সমাজের মূল্যবোধের বিপরীত একটি বার্তা দেয় এবং মনে করিয়ে দেয় যে সমাজে যেকোনো ধরনের শোষণ, নারী বা পশু, উভয়ের ক্ষেত্রেই অগ্রহণযোগ্য।
সব মিলিয়ে, "শামুক" কবিতাটি নারীবাদী, পরিবেশবাদী এবং মানবাধিকারের দিক থেকে একটি শক্তিশালী কাব্যিক প্রকাশ। এটি আমাদের সমাজের শোষণ, সহিংসতা এবং বৈষম্য নিয়ে ভাবতে বাধ্য করে এবং সামাজিক কাঠামোর মধ্য বেড়ে ওঠা বিভেদের বিরুদ্ধে এক তীব্র প্রতিবাদ হিসেবে উঠে আসে।
----------------------------------------------------------------
শব্দার্থ :
১) বিলাপ (বি.) -- খেদোক্তি, শোকপ্রকাশ (পুত্রশোকে বিলাপ করা)। [সং. বি + √ লপ্ + আ]
২) গাথা (gāthā) (বি.) -- 1 গেয় শ্লোক; 2 দেবতা অথবা কীর্তিমান নৃপতি ইত্যাদির প্রশংসামূলক গান ; 3 কাহিনিমূলক কবিতা, শ্লোক, গীতিকবিতাবিশেষ, ballad; 4 মঙ্গলকাব্যের পালাগান; 5 বর্ণনা (গুণগাথা) [সং. √গৈ + থ + আ]।
>> সঠিক উত্তরটি বেছে নিয়ে লেখ: (MCQ) [1]
1. শামুকের খোলাগুলির মড়মড় করে ভাঙার শব্দের মধ্যে লেখক কী লক্ষ করেছিলেন? (ক) অদ্ভুত গান (খ) অদ্ভুত ছন্দ (গ) অদ্ভুত কবিতা (ঘ) অদ্ভুত ঘটনা
উ: (খ) অদ্ভুত ছন্দ
2. অদ্ভুত ছন্দের মধ্যে শামুকগুলির কী লুকিয়েছিল? (ক) শোক তাপ বিলাপ (খ) শোক বিলাপ তাপ (গ) তাপ বিলাপ শোক (ঘ) কোনোটিই নয়
উ: (ক) শোক তাপ বিলাপ
>> ২০ টি শব্দে উত্তর দাও: [1]
1. 'শামুক' কবিতাটির মূল কাব্যগ্রন্থের নাম কী? কবি কোথা থেকে শামুক তুলেছিল?
উত্তর: অনুপমা বসুমাতরি অসমিয়া ভাষার কবি। তার রচিত "রূপালী রাতের ঘাট" (অসমিয়া: রূপালি রাতির ঘাট) কাব্যগ্রন্থ থকে "শামুক" কবিতাটি নেওয়া হয়েছে। কবি ধানগাছের ফাঁকে ফাঁকে উপুড় হয়ে পড়ে থাকা শামুকদের খলুইতে তুলে নিয়েছিল।
>> কমবেশি ৬০ টি শব্দে উত্তর দাও। [3]
1. "একটা অদ্ভুত ছন্দ ছিল / যার মধ্যে লুকিয়েছিল মরা শামুকগুলোর শোক তাপ বিলাপ।"-- "অদ্ভুত ছন্দ" বলতে কবি বুঝিয়েছেন লেখ।
উত্তর:
"অদ্ভুত ছন্দ" বাক্যাংশটি শামুকের খোলসের মড়মড় করে ভেঙে যাওয়ার শব্দকে বোঝায়। এই ভেঙে যাওয়া যেন তাদের যন্ত্রণাকে প্রকাশিত করছে। আপাতদৃষ্টিতে এটি একটি খাদ্য সংগ্রহের স্বাভাবিক প্রক্রিয়া মনে হলেও, এই ছন্দটি প্রতীকী। বিশেষত প্রান্তিক মানুষ, নারী ও প্রতিবাদহীনদের প্রতি সমাজের নিষ্পেষণকে শামুক শিকারের হিংস্রতার মধ্য দিয়ে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। এবং এই হিংস্রতা মানব সমাজে খুবই স্বাভাবিক একটি প্রবৃত্তি। কবি এই রূপকে পিতৃতান্ত্রিক চাপে নারীর বেদনার নীরব ছন্দটিকে ধ্বনিত করতে চেয়েছেন।